সন্ধ্যার পর রাজ্যের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল সুনামগঞ্জ শহরে। দুই দিন ধরে জেলা বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন। নেই মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক। ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ। মোমবাতি আর জ্বালানি তেলের সংকটে অনেক বাসায় জ্বলেনি আলোও। এর মধ্যে টানা বৃষ্টি ও বজ্রপাত ছিল। সব মিলিয়ে ভুতুড়ে পরিস্থিতি। এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার বিভীষিকাময় একটি রাত পার করল বন্যার পানিতে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া সুনামগঞ্জের মানুষ।
আজ শনিবার সকালে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে। কমবেশি একই চিত্র ছিল জেলার ১২টি উপজেলাতেও। বন্যাকবলিত লোজজন জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জে গত বুধবার থেকে তৃতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে জেলার সব উপজেলাই বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার অবস্থা শোচনীয়। এখানে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।
সুনামগঞ্জ শহরে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ আছে। এ কারণে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির বিষয়টি সুনামগঞ্জের বাইরে থেকে অনেকে জানতে পারছে না। এতে জেলার বাইরে থাকা সুনামগঞ্জের মানুষ ও স্বজনেরা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনেরা কোন পরিস্থিতিতে আছেন, সেটা জানতে না পারছেন না তাঁরা। কেবল এতটুকু জানতে পেরেছেন, বন্যার পানি ক্রমে বাড়ছে। শহরের শতভাগ বাসাবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। একেক ঘরে হাঁটু থেকে কোমরসমান পর্যন্ত পানি। নৌকার অভাবে অনেকে নিরাপদ স্থানেও যেতে পারছেন না।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ শহরের অধিকাংশ বাসার চুলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় রান্নাবান্না বন্ধ আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সংকট আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় শহরে খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে। বিশুদ্ধ পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। টানা বৃষ্টিপাত আর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বানভাসি মানুষের আশঙ্কা আরও বাড়ছে। বন্যার পানিতে জেলায় আটকে পড়া মানুষের উদ্ধারে সেনাবাহিনী কাজ করেছে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
কলমাকান্দার ৮৫ বছরের বৃদ্ধ বললেন, ‘এমন বন্যা কখনো দেখিনি’
সিলেট–সুনমাগঞ্জে বন্যার্তদের জন্য সেনাবাহিনীর টোল ফ্রি নম্বর
শেরপুরে বন্যার পানিতে ভেসে নিখোঁজের ১৫ ঘণ্টা পর দুজনের লাশ উদ্ধার
বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জ জেলার যোগাযোগ স্থাপনকারী সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার থেকে পুরো জেলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলার সঙ্গে উপজেলা সদরের সড়কগুলোও ডুবে যাওয়ায় প্রতিটি উপজেলা এখন কার্যত বিচ্ছিন্ন। গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে যাচ্ছে গবাদিপশু ও পাখি। নৌকার সংকটে মানুষ নিরাপদে আশ্রয়ের খোঁজেও খুব একটা যেতে পারছে না। এর মধ্যে জেলাজুড়ে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় প্রসূতি ও অসুস্থ ব্যক্তিদের ভোগান্তি বেড়েছে। পানি ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক বাড়িতেই কোমরসমান পানি। মানুষ আতঙ্কে আছে। আপাতত জীবন রক্ষার জন্য মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। অনেকে ত্রাণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সুনামগঞ্জের মানুষ।
বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির কারণে স্থানীয় প্রশাসনও জেলার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে পারছে না। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ সুনামগঞ্জের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম বন্যা পরিস্থিতি অতীতে কখনোই সুনামগঞ্জে হয়নি। জেলার অধিকাংশ সড়ক-রাস্তা ডুবে যাওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। তবে প্রশাসন আন্তরিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করে চলেছে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সুনামগঞ্জের পর সিলেটও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন