সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা মুঠোফোন, সিমকার্ড ও কাপড়চোপড় বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়ার বলে শনাক্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পলায়ন বা হেফাজতে নির্যাতনে হত্যার ঘটনার সঙ্গে মুঠোফোন ব্যবহারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি যাচাইয়ে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
আকবরের মালপত্র পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তরের দুই দিন পর আজ রোববার এ তথ্য জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধার করা মালপত্রের মধ্যে মুঠোফোন ও সিমকার্ড ঘটনার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, এসব তথ্য অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে পিবিআইয়ের কাছে আকবরের মালপত্র হস্তান্তর করে সিলেটের কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানা-পুলিশের একটি দল। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ডোনা এলাকা থেকে পলাতক আকবর ধরা পড়ার ১২ দিনের মাথায় গত বৃহস্পতিবার রাতে কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বে একদল পুলিশ আকবরের ব্যবহৃত মুঠোফোন, সিমকার্ডসহ কাপড়চোপড় উদ্ধার করে। সমতল থেকে বেশ উঁচু একটি পাহাড়ের চূড়ায় এগুলো ফেলে রাখা ছিল।
সিলেট জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, একটি বাক্সের মধ্যে দুটো মুঠোফোন, কাগজ দিয়ে মোড়ানো তিনটি সিমকার্ড, শার্ট-প্যান্ট ও গেঞ্জি একটি কালো ব্যাগে রাখা ছিল। সেখানে একটি ২০ টাকার নোট, আকবরের পলাতক থাকা অবস্থার দুটো পাসপোর্ট সাইজ ছবি ও দুজন নারীর পাসপোর্ট সাইজ ছবি পাওয়া যায়। আকবরের মালপত্র পাহাড়ের চূড়ায় ফেলা রাখার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুদ্দোহা ও জকিগঞ্জ থানার ওসি মীর মো. আবদুন নাসের তা উদ্ধারে নেতৃত্ব দেন। একই স্থান থেকে ৯ নভেম্বর আকবরকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময়ও এই দুই ওসি উপস্থিত ছিলেন।
গত ১০ অক্টোবর সিলেট নগরের আখালিয়া এলাকার রায়হান আহমদকে (৩৪) বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরদিন তিনি মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার কোতোয়ালি থানায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন। মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে নির্যাতনের সত্যতা পায়। ১২ অক্টোবর ওই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১৩ অক্টোবর আকবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে যান। ২৭ দিন পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে আকবরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। রিমান্ড শেষে গত মঙ্গলবার আকবরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
সীমান্ত এলাকার একটি সূত্র জানায়, আকবর ১৪ অক্টোবর কোম্পানীগঞ্জের উৎমা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি কুমার দেব নাম ধারণ করেন। তিনি শিলচর এলাকায় গোপাল নামের এক ব্যক্তির ভাই পরিচয় দিয়ে খাসিয়া সেজে বাস করছিলেন। তিনি সেখানে খাসি ও হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন। গোপন সূত্রের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত হয়ে ভারতীয় খাসিয়া ও সীমান্ত এলাকার লোকজনের সহায়তায় ডোনা এলাকায় এনে আকবরকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা পুলিশের একটি দল।
ওই সূত্রে আরও জানা যায়, আকবর পালিয়ে ভারতের যে এলাকায় অবস্থান করছিলেন, সেখান থেকে লোক মারফত জিনিসপত্রগুলো ডোনা সীমান্তের পাহাড়ে রেখে যাওয়া হয়। এরপর পুলিশ গিয়ে সেগুলো উদ্ধার করে। আকবরকে পালাতে সহায়তাকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতেই এগুলো উদ্ধার করা হয়।
মুঠোফোন ও মালপত্র আকবরের বলে শনাক্ত হওয়ার পর তাঁকে পালাতে সহায়তাকারীদের চিহ্নিত করা হবে কি না, এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রায়হানকে নির্যাতনে হত্যার ঘটনায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা মামলার সন্দিগ্ধ আসামি সাইদুল শেখও তিন দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে কোনো জবানবন্দি দেননি। গতকাল শনিবার রিমান্ড শেষ হলে বিকেলে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক আওলাদ হোসেন আজ প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এর আগে মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া ১৭ নভেম্বর সাত দিনের রিমান্ড শেষে কোনো জবানবন্দি দেননি। একইভাবে দুই দফা রিমান্ড শেষে গ্রেপ্তার হওয়া বরখাস্ত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও হারুন অর রশিদ এবং ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার হওয়া এএসআই আশেক এলাহী রিমান্ড শেষে আদালতে কোনো জবানবন্দি দেননি।
পিবিআই সূত্র জানায়, ১০ অক্টোবর রায়হানকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় সাইদুল শেখ সঙ্গে ছিলেন। রায়হানের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা ব্যক্তি সাইদুল ঘটনার পর থেকে পলাতক ছিলেন। ঘটনার ১০ দিনের মাথায় ২৫ অক্টোবর তাঁকে শনাক্ত করে আটক করার পর হেফাজতে মৃত্যুর মামলায় তাঁকে সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। সপ্তাহখানেক পর ২ নভেম্বর সিলেট কোতোয়ালি থানায় নগরীর লন্ডনি রোড এলাকার বাসিন্দা আফজাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি সাইদুলের বিরুদ্ধে সৌদি রিয়াল ভাঙানোর কথা বলে প্রতারণামূলকভাবে ১ লাখ ২৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি লিখিত অভিযোগ দেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় সাইদুল শেখের বিরুদ্ধে মামলাটি নথিভুক্ত হয়।
আফজাল পেশায় একজন চিকিৎসকের গাড়িচালক। তিনি নগরীর লন্ডনি রোড এলাকায় বসবাস করেন। নিহত রায়হান নগরীর রিকাবিবাজার এলাকায় তিনজন চিকিৎসকের দপ্তরে সহকারী পদে চাকরি করতেন। সাইদুলও রিকাবিবাজার পার্শ্ববর্তী মিরের ময়দান এলাকায় বসবাস করতেন। রায়হানকে পুলিশ ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পেছনে আগের কোনো শত্রুতা ছিল কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে করা মামলাটি তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পিবিআই দুটো ঘটনা সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন। তবে এসব তথ্য বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।