অজ্ঞাত রোগে গবাদিপশুর মৃত্যুর কারণ মাত্রাতিরিক্ত সিসা। সিসা কারখানার ফলে হুমকিতে এলাকার জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য।
বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের একটি গ্রাম আঙ্গুলকাটা। এই গ্রামের মাটিতে প্রয়োজনের তুলনায় ১৩৮ গুণ সিসার উপস্থিতি মিলেছে। গ্রামের জমিতে উৎপাদিত খড়ে সিসার উপস্থিতি ২ হাজার ৫৫৬ গুণ। গ্রামের মাটি ও কৃষিপণ্যের সাতটি নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্য দিয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট।
এমন অবস্থায় ওই এলাকার জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রাণঘাতী সিসার বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে সেখানকার খেতখামারে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খাদ্যতালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত বলেও মত তাঁদের।
গত বছরের ডিসেম্বরে আঙ্গুলকাটা গ্রামে হঠাৎ অজ্ঞাত রোগে অন্তত ১৫টি গরুর মৃত্যু হয়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে আরও ২৫টি গরু। আতঙ্কিত কৃষকেরা ছুটে যান উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে। চিকিৎসকেরা গরুগুলোকে প্রচলিত ওষুধ প্রয়োগ করলেও আশানুরূপ ফল পাননি। এ অবস্থায় অসুস্থতার সঙ্গে মাটি ও পানিদূষণের যোগসূত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটকে অনুরোধ জানায় প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
কারণ অনুসন্ধানে গত ৩১ ডিসেম্বর মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের পটুয়াখালী কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এফ এম মামুন ও আমতলী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন আতিকুর রহমান ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই এলাকায় অবৈধ সিসার মণ্ড তৈরির একটি কারখানার সন্ধান পান তাঁরা। এরপর তাঁরা কারখানা–সংলগ্ন মাঠ থেকে চারটি মাটির, দুটি ধানের খড়ের ও আক্রান্ত এলাকাসংলগ্ন পায়রা নদীর পানির একটি নমুনা সংগ্রহ করেন। এসব নমুনার রাসায়নিক বিশ্লেষণের জন্য ঢাকায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে পাঠানো হয়। গত ১ জানুয়ারি এর ফলাফল আসে।
প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, মাটির দুটি নমুনার একটিতে সিসার উপস্থিতি প্রতি গ্রামে ১৯৩ দশমিক ৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং অপরটিতে ১২৩ দশমিক ৭৩ মাইক্রোগ্রাম। দুটি খড়ের নমুনার একটিতে প্রতি গ্রামে ৪২২ দশমিক ২৬ মাইক্রোগ্রাম এবং অপরটিতে ১ হাজার ১১১ দশমিক ১৭ মাইক্রোগ্রাম। তবে পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতির মাত্রা সহনীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব খাদ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী মাটি, পানি ও শাকসবজিতে সিসার অনুমোদিত মাত্রা যথাক্রমে প্রতি গ্রাম মাটিতে শূন্য দশমিক শূন্য ৬৫, পানিতে ১০০ এবং উদ্ভিদে শূন্য দশমিক ৩০ মাইক্রোগ্রাম।
ওই এলাকায় এ বছর তেমন আমনের ফলন হয়নি। সিসার প্রভাবে ওই এলাকার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে রয়েছে।সি এম রেজাউল করিম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, আমতলী বরগুনা
মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের বরিশাল কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ এই প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে এই প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়েছি। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
আমতলী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার মোদক বলেন, অতিমাত্রায় সিসার বিষক্রিয়াতেই এসব গরু মারা গেছে। সিসা কারখানা থেকে এলাকার প্রাণিকুল রক্ষায় মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। ওই এলাকার গবাদিপশুকে খড়, ঘাস ধুয়ে ও রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়াতে বলা হয়েছে। অবৈধ সিসা কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
শুধু গবাদিপশু নয়, হুমকিতে পড়েছে এলাকার জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্য। উপজেলা কৃষি কর্মকতা সি এম রেজাউল করিম বলেন, ওই এলাকায় এ বছর তেমন আমনের ফলন হয়নি। অনেক স্থানের ধান পুড়ে গেছে। সিসার প্রভাবে ওই এলাকার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে রয়েছে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ২০১৮ সালের শেষ দিকে গ্রামের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপরে স্থানীয় প্রভাবশালী ইউপি সদস্য আবদুস ছত্তার ফকিরের ছেলে ইয়ামিন ফকির পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই সিসা তৈরির অবৈধ কারখানা গড়ে তোলেন। এরপর সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে পুরোনো ব্যাটারি ভেঙে সিসা গলানো হতো। ১৫ দিন আগে কারখানা কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন।
গত সোমবার কারখানা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপরে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়। কারখানার ভেতরে অনেকগুলো চুল্লি তৈরি করে পরিত্যক্ত ব্যাটারির সিসা গলানো হতো। আশপাশে গলানো সিসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। তবে বন্ধ কারখানায় কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ ১২ জন কৃষকের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলেন, যাঁরা কারখানা তৈরি করে এমন সর্বনাশ করেছে, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
মুঠোফোনে কারখানার মালিক ইয়ামিন ফকির বলেন, সিসার বিষক্রিয়া নয়, অন্য কোনো রোগে এসব গরু মারা যেতে পারে। তবু তাঁরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন।
সিসা গলানোর সময় বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, এর প্রভাবে মানবদেহে অ্যাজমা, হৃদ্রোগ ও ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, সিসা কারখানা গড়ে তোলা পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ। দ্রুত ওই কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।