মিসবাহউদ্দিন সিরাজ তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন হওয়া নেতা। ১৯৭৭ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি তাঁর। ১৯৮১ সালে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হন। ২০০২ সালে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ২০০৯ সাল থেকে পরপর তিন মেয়াদে তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলেন। একটানা ৪০ বছর পর তিনি গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পদ থেকে বাদ পড়েন। একটানা ১০ বছর থাকা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়ান। সম্প্রতি সিলেটে তরুণী ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলেটে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল মেহেদী।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে একটানা দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন। সিলেটে সরকারি কৌঁসুলির (পাবলিক প্রসিকিউটর) দায়িত্বে টানা ১০ বছর ছিলেন। টিলাগড়ে ছাত্রলীগের বিরোধে একের পর এক খুন, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাসী ঘটনায় মামলা হলেও বিচার হয়নি একটিরও। এমসি কলেজ ছাত্রাবাস পোড়ানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে দোষী চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেটিও আটকে আছে। সর্বশেষ ঘটল ধর্ষণের ঘটনা। আপনি কী বলেন?
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: শুরুতেই বলব আমি ব্যর্থ। রাজনীতিবিদ হিসেবেও ব্যর্থ, আইনজীবী হিসেবেও ব্যর্থ। এসব ঘটনা একের পর এক ঘটেছে। মামলাও হয়েছে। কিন্তু ঘটনা সংঘটনকারীদের পেছনে আমাদের রাজনৈতিক কিছু নেতার আশকারা ছিল। ঘটনা ঘটলেই শুরু হতো ‘ব্লেম গেম’। এরপর বিচার পর্যায়ে নিতে গেলে পদে পদে বাধা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রভাবিত হতো, নয়তো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। এ জন্য বিচার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ধর্ষণকাণ্ডের আগের ঘটনাগুলোর অধিকাংশ যেহেতু আমার সময়কালের মধ্যে ঘটেছে, তাই দায় তো আমারও আছে। কিন্তু এই দায় এখন সবার হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: সবার দায় হবে কেন? একটু ব্যাখ্যা করবেন?
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: আমি ৪০ বছর একনাগাড়ে সিলেটে আওয়ামী লীগের একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে নেতৃত্বে ছিলাম। এখন নেই। নেতৃত্বে ছিলাম পাশাপাশি আইন পেশায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। মাঠের পরিস্থিতি, রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা, দুর্বৃত্তপনার ঘটনাগুলো বিচার পর্যন্ত পৌঁছাত না। এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানোর পর আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের দাবি অভিন্ন ছিল। ঐতিহ্যবাসী ছাত্রাবাস অবিকল আগের কাঠামোয় নির্মাণ করতে হবে আর অগ্নিসংযোগকারীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু প্রথমটি দ্রুত সম্ভব হলেও দ্বিতীয়টি হয়নি। কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত নানা কায়দায় ঠেকানো হয়েছে। বিচার বিভাগীয় তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সেখানেও ছিল রাজনৈতিক চাপ। এ জন্য এককভাবে কিছু করা আর সম্ভব না। সবাইকে দায় নিয়ে দায়িত্বশীল হতে হবে।
প্রশ্ন: সবার কাঁধে দায় চাপানো কি নিজের দায় এড়ানো নয়?
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: না, নিজের দায় থেকেই তো বলছি, আমি ব্যর্থ। আমার সময়ে আমি এমনও দেখেছি যে প্রধানমন্ত্রী সিলেট সফরে এসেছেন। সফরের আগের দিন পর্যন্ত তাঁরা (টিলাগড় ছাত্রলীগ) চিহ্নিত থাকে, গোয়েন্দারা তৎপর থাকে তাঁরা যাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি যেতে না পারেন। কিন্তু শেষে আর তা ঠেকানো যায় না। প্রধানমন্ত্রীর সফর শেষে দেখা যায় ফেসবুক তাঁদের ছবিতে ভেসে যায়। তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা হচ্ছেন তাঁদের গ্রুপের নেতা। এই গ্রুপ লিডারদেরও বিচার করতে হবে। অন্যথায় অপকর্ম চলতে থাকবে।
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন, টিলাগড়ে আপনার অনুসারীও আছে। ছাত্রাবাস পোড়ানোর বিচার, হত্যা ও অস্ত্রবাজি মামলার বিচার আপনি পিপি থাকা অবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়েছে। এই দায় এড়াবেন কী করে?
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: আমি দীর্ঘসময় পিপি ছিলাম, একই সঙ্গে রাজনৈতিক দায়িত্বেও ছিলাম। পিপির দায়িত্ব আর রাজনীতি এক করিনি। ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি তখন রাজনৈতিক কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিনটি সংস্থা তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে বিচার বিভাগীয় তদন্তে অপরাধী চিহ্নিত হয়, বিচারও শুরু হয়। সেখানেও রাজনৈতিক চাপ ছিল। রাজনৈতিক চাপ কী রকম, কারা কারা সক্রিয় ছিলেন, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় দেখতে পেরেছি। এ জন্য বলেছি যে আমি রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে বলছি, রাজনৈতিক এই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলায় সমন্বিত প্রতিরোধ দরকার। যেখানে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসনসহ সব সেক্টরের অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
প্রশ্ন: সর্বশেষ ধর্ষণকাণ্ডে দ্রুত বিচার ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি উঠেছে। এই দাবি ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বলুন।
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সব ধরা পড়েছে বলে বসে থাকলে হবে না। তাঁরা যাদের অনুসারী, তাঁরা বাইরে নানা রকম কলকাঠি নাড়ছেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার নানা রকম তৎপরতা চলছে। শাসক দলে আছে বলে সরকারের সব সেক্টরে তাঁদের ওঠাবসা আছে। আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের সমান অপরাধী বিবেচনায় আইনের আওতায় আনতে হবে। এক কথায়, টিলাগড় এলাকা, এমসি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা শুদ্ধি অভিযান দরকার। ধর্ষণকাণ্ডে গ্রেপ্তার কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশের বেশ সখ্য ছিল। এই সখ্যের মধ্যে পুলিশ কী করে তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করবে? যাঁদের সঙ্গে ওঠাবসা নেই, এমন সংস্থা দিয়ে তদন্ত করতে হবে। যেমনটা আমার সময়ে (পিপি থাকাকালে) আলোচিত রাজন হত্যা ও খাদিজাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: রাজন হত্যা ও খাদিজা হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তো রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছিল না। এ জন্য বিচারকার্য দ্রুত হয়েছে। এখানে তো সমস্যা আপনার রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়াটাই। কী বলেন আপনি?
মিসবাহউদ্দিন সিরাজ: রাজন হত্যার ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা তো হয়েছিল। আপনাদের (প্রথম আলো) একটা রিপোর্ট ও নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে রাজনৈতিক নেতারা সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর খাদিজার বেলায় হত্যাচেষ্টাকারীর ছাত্রলীগের পরিচয় ছিল। আমি এসব কিছু পরোয়া করিনি। রাজনের বাড়ি থেকে কোর্ট পর্যন্ত তৎপর ছিলাম। খাদিজার বেলায়ও তাই। আমার ব্যর্থতার মধ্যে সফলতা এই দুই ঘটনা। এই অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, টিলাগড়ে একটা শুদ্ধি অভিযান দরকার। ক্যাসিনো-কাণ্ড অথবা ফরিদপুরের মতো কিছু করতে হবে। নইলে আওয়ামী লীগ আর জনবান্ধব রাজনৈতিক দল থাকবে না।