কথা ছিল যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক হবে বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি। মেধাভিত্তিক অর্থনীতির দ্বার উন্মোচিত হবে পার্কটি চালুর মাধ্যমে। তিন বছর পর সেটি এখন হতাশার নাম।
কেন হতাশা? কারণ, বিনিয়োগ ততটা হয়নি, যতটা প্রত্যাশিত ছিল। বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি বললেই চলে। বর্তমান বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগ প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল মার্কেটিং, কল সেন্টার পরিচালনা ও গ্রাফিকস ডিজাইনিংয়ের কাজ করেন। কর্মসংস্থানের লক্ষ্য পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেনি পার্কটি। বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ পার্কটি ছেড়েছেন। বিপুল ব্যয়ে নির্মিত ডরমিটরি বা আবাসনসুবিধা খালিই থাকছে। সম্মেলনকেন্দ্র বা অ্যাম্ফিথিয়েটার বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করা হয়। যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরের কিছু বেশি জমিতে পার্কটি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকা। এটি চালুর আগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছিলেন, যশোর হাইটেক পার্ক হবে বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি বহু প্রযুক্তি কোম্পানির আঁতুড়ঘর। গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সেটি অদ্বিতীয়।
যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁকে এ-সংক্রান্ত প্রশ্নও লিখে পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।
বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু সমস্যা আছে। বিনিয়োগকারীদের নানা চাহিদা আছে। ভাড়া মওকুফ, বিদ্যুৎ বিল মওকুফসহ অনেক কিছুই তাঁরা চাইতে পারেন। কিন্তু এটা তো কোনো সংস্থা করতে পারে না। বিনিয়োগকারীদের সব চাওয়া সঠিক নয়।
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে না পারার বিষয়ে হোসনে আরা বলেন, ‘বড় প্রতিষ্ঠান আসার চেয়ে সফটওয়্যারের কাজ হবে, তেমনটাই কথা ছিল। বড় প্রতিষ্ঠান এলে তাদের আমরা উৎসাহ দেব। বড় প্রতিষ্ঠান না আসায় সে উৎসাহের বিষয়টি হয়নি।’
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন পর্যন্ত যশোর হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ এসেছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। পার্কটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেক সিটি জানিয়েছে, সেখানে ৫০টি প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে কার্যক্রমে রয়েছে ৩৮টি। অবশ্য সরেজমিনে ৩২টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পাওয়া যায়।
পার্কটির মূল ১৫ তলা ভবনে ১ লাখ ৩৭ হাজার বর্গফুট জায়গা ইজারাযোগ্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া প্রায় ৯৫ হাজার বর্গফুট। ৩টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে ফেলে রেখেছে। ফলে ৩৮ শতাংশ জায়গা এখনো খালি রয়েছে। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থানও হয়নি। মোট ১ হাজার ৪০০ কর্মী সেখানে কাজ করেন। তবে প্রতিষ্ঠার সময় পাঁচ হাজার কর্মীর কাজ পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
বিনিয়োগের ধরনও খুব বেশি আশাজাগানিয়া নয়। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই প্রশিক্ষণধর্মী। তারা বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণের কাজ করে। সফটওয়্যার তৈরি করে, এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ছয়টি, যা হলো মাইক্রো ড্রিম আইটি, টেকনোসফট বাংলাদেশ, সফট এক্স টেকনোলজি, ডেসটিনি আইএনসি ডট, সেমিকোলন আইটি ও অংশ ইন্টারন্যাশনাল। কিছু প্রতিষ্ঠান কল সেন্টার পরিচালনা, ডিজিটাল বিপণন, গ্রাফিকস ডিজাইনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। সূত্র জানায়, পার্কটিতে বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই। ডেসটিনি আইএনসি ডট নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে জাপানি বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আসলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক বাংলাদেশি, যিনি জাপানে থাকেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তারের এন সল্যুশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে যশোর হাইটেক পার্কে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যশোর হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করবে। তাদের মাধ্যমে আমরাও শিখব। কিন্তু কিছুই হয়নি।’ এখন নিজের প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কার কথা জানান তিনি।
৩ বছরে ১৭টি প্রতিষ্ঠান যশোর হাইটেক পার্ক ছেড়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা যেসব প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে একটি বড় সমস্যা দক্ষ জনবল না পাওয়া। ইজারামূল্য নিয়ে বিরোধ, উন্নত বিদ্যুৎ সেবা না থাকা এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়াকেও সমস্যার তালিকায় যুক্ত করছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সরকারের যেসব স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়, তাতে কোনো দক্ষ কর্মী তৈরি হয় না। ২০১৭ সালে যশোর পার্কে বেশ আয়োজন করে চাকরি মেলা করা হয়েছিল। চাকরিপ্রার্থীদের প্রচুর আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু সেখান থেকে জনবল তৈরি হয়নি।
সে সময়ে যশোর পার্কের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন যুগ্ম সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম (বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক তরুণ সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু এটা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের, তাই সবার আবেদন নেওয়া যায়নি।’
একটি ডেটা সেন্টার করতে চেয়েও যশোর হাইটেক পার্কে তা করতে পারেনি ঢাকাকোলো লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ডেটা সেন্টারের জন্য বিদ্যুতের একাধিক বিকল্প উৎস থাকতে হয়। অন্তত দুটি জেনারেটর থাকতে হবে। কিন্তু হাইটেক পার্কে জেনারেটর বসানোর মতো কোনো জায়গা নেই। বিদ্যুতের বিকল্প উৎসও পাওয়া যায়নি।
যশোর হাইটেক পার্কটিকে ১৫ বছরের জন্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টেকসিটি বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। তাদের নিয়ে বিনিয়োগকারীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। একটি হলো ইজারামূল্য। কোনো প্রতিষ্ঠানের বর্গফুটপ্রতি ১৮ টাকা, কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২২ টাকা ভাড়া নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সূত্র জানিয়েছে, ছয়টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের ভাড়া তিন মাসের বেশি বকেয়া রয়েছে। অবশ্য যারা হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছিল, তাদের ভাড়া পড়েছে বর্গফুটপ্রতি ১৪ টাকা।
টেকসিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে নীতিগত কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেটা ভেবে হাইটেক পার্কের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক পার্থক্য। এত বড় একটা অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনার খরচ অনেক। অনেক কিছু হিসাব না করেই সরকার সেখানে ভাড়া নির্ধারণ করেছিল। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, বিনিয়োগকারীদের অনেকে ভাড়া দিচ্ছেন না। তাঁদের কাছে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা ভাড়া বাকি।
যশোর হাইটেক পার্কে ডরমিটরিটি তিন তারকা মানের। মোট কক্ষ ৯০টি। ভিআইপি সুইট কক্ষ ১২টি, ফ্যামিলি ডিলাক্স কক্ষ ৩৬টি ও দুই বিছানার কক্ষ ৩০টি। ১৪০ জনের মতো থাকার সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। ভিআইপি কক্ষে থাকার জন্য প্রতি রাতের ভাড়া ৭ হাজার ৬০০ টাকা ও অপর দুই ধরনের কক্ষের ভাড়া ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে। তবে পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাড়া নির্ধারিত আছে ৮০০ টাকা।
কথা ছিল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী, ক্রেতা ও কর্মীরা গেলে ডরমিটরিতে থাকবেন। যদিও এখন বেশির ভাগ কক্ষ সব সময় খালি থাকে। ২২ অক্টোবর গিয়ে দেখা গেছে, মাত্র ১২ জন অতিথি আছেন। পুরো সেপ্টেম্বর মাসে ডরমিটরিটিতে ১৬২ জন অতিথি ছিলেন।
সম্মেলন কেন্দ্র বা অ্যাম্ফিথিয়েটার করা হয়েছিল সম্মেলন, সভা-সেমিনার করার জন্য। এখন বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্যও ভাড়া দেওয়া হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে যশোরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীর ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল অ্যাম্ফিথিয়েটারে। সেখানে অতিথি ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত ততটা বড় হয়নি। এমন তো নয় যে দেশে হাজার হাজার কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। কোম্পানি যদি তৈরি না হয়, হাইটেক পার্কে কারা যাবে? তিনি বলেন, দেশে বেশির ভাগ কোম্পানির জনবল ২০ থেকে ৩০ জন। এত কম লোক নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের ঢাকার বাইরের পার্কে যাওয়া পোষাবে না।
ফাহিম মাশরুরের মতে, শুধু পার্ক বানালেই হবে না, প্রযুক্তি খাত যাতে বড় হয়, চাহিদা তৈরি হয়, সে ব্যাপারে সরকারকে কাজ করতে হবে। এসব পার্ক নির্মাণের আগে দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়েও মনোযোগী হতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সরকার ২৮টি হাইটেক পার্ক করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। পরে ৬৪টি জেলায় হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিগত পাঁচ বছরে ঢাকায় জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, নাটোরে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার এবং রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক চালু হয়েছে।
এ বিষয়ে বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্প করার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দক্ষ জনবল থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হয়। নিয়ম হচ্ছে, পাইলট (পরীক্ষামূলক) প্রকল্প করা। তার সফলতার ভিত্তিতে বাকিগুলো করতে হয়। এতে আগের ভুল বা সমস্যাগুলো যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। আমাদের এখানে সেটা হচ্ছে না। প্রকল্প করতে হবে, তাই করা হয়।’