নালায় পড়ে ছাত্রীর মৃত্যু

সিটি করপোরেশন ও সিডিএর পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

চট্টগ্রাম শহরের এই নালায় পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামে উন্মুক্ত নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ নগরবাসী সেবা সংস্থাগুলোর গাফিলতিকে দায়ী করছে। এ ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছেন নিহত ছাত্রীর সহপাঠীরা।

এদিকে নগরীর সড়কে চলাচলের সময় এ ধরনের দুর্ঘটনায় যাতে পড়তে না হয়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এ ঘটনার দায় নিচ্ছে না। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে তারা।

সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে থেকে বলা হয়েছে, সিডিএর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নির্মাণকাজের জন্য সড়কের নিরাপত্তাবেষ্টনী তুলে নেওয়া হয়েছে, সেটাই এই দুর্ঘটনার পথ তৈরি করে দিয়েছে। অপর দিকে অভিযোগ নাকচ করে সিডিএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন নালা পরিষ্কার না করায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।

এর আগে গত ২৫ আগস্ট নগরীর চশমা খালে তলিয়ে গিয়েছিলেন সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদ (৫০)। এক মাস পরও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই খালে সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলছে। এই ঘটনায়ও সিটি করপোরেশন ও সিডিএ পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করতে থাকে।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় শেখ মুজিব সড়কসংলগ্ন নালায় পড়ে যান। পরে রাত তিনটার দিকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার সকালে নগরের হালিশহরের বড়পোল এলাকায় তাঁকে দাফন করা হয়। মঙ্গলবার সকালে প্রথম বর্ষের মিডটার্ম পরীক্ষা ছিল তাঁর।

সোমবার রাতে শেহেরীনকে চোখের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান নানা হাজি জামাল। সঙ্গে ছিলেন শেহেরীনের মামা মো. জাকির হোসেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চশমা কিনে বাসায় ফিরছিলেন তিনজন। এ সময় আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকায় ফুটপাত থেকে পা পিছলে নালায় পড়ে যান শেহেরীন। মামা ও নানা লাফ দিয়েও তাঁকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গভীর রাতে তাঁর লাশ উদ্ধার করেন।

যা বললেন সিটি করপোরেশন ও সিডিএ কর্তারা

বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর মৃত্যুর পর মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দায়ী কারা, এটা বলব না। ওখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যে নালাটা ছিল, সেখানে নালার পাশে রেলিং ছিল। সেগুলো নেই। বৃষ্টি পড়ায় ফুটপাতের ওপর কাদা জমে গেছে। যেটুকু খবর পেয়েছি, কাদায় স্লিপ করে মেয়েটি পড়ে গেছে।’

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এখানে যারা প্রকল্পের কাজ করছে, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। একটা বাঁশ দিয়ে যদি লাল নিশান দেওয়া হতো, তবু মানুষ তো বলতে পারত। এখানেও করা উচিত ছিল। যারা কাজ করছে, তাদের কিছুটা অবহেলা আছে।

মেয়র বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যে কাজ চলছে, তা সিডিএর আওতায়। সিটি করপোরেশনের আওতায় নেই। অনেক জায়গায় গর্ত হয়েছে। কয়েক দিন আগেও সিডিএ চেয়ারম্যানকে ফোন করেছি। তাঁরা কাজ করছে। অবহেলা ও অসতর্কতার জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। যেহেতু কাজ চলছে, কাজের সব ময়লা সেখানে গিয়ে পড়ছে। পাশে যে ফেন্সিং ছিল, তা থাকলে দুর্ঘটনা ঘটত না।

রেলিং ছিল এবং বড় স্ল্যাব ছিল। এসব কাজ করতে গিয়ে নষ্ট করা হয়েছে।’
৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সিডিএ। নগরের সিডিএ অ্যাভিনিউ, শেখ মুজিব সড়ক ও বিমানবন্দর সড়কের ওপর এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। ইতিমধ্যে শেখ মুজিব সড়ক ও বিমানবন্দর সড়কের ওপর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ। মঙ্গলবার বিকেলে সিডিএ ভবনে চেয়ারম্যান কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ সিটি করপোরেশনকে গৃহকর দিচ্ছে। কাজ করার জন্য কর দিচ্ছে। এখন তারা কাজ না করলে তো হবে না। তারা নালা পরিষ্কার করছে না। সিডিএর ওপর দায় চাপিয়ে দিলে হবে না।

নালায় পড়ে যাওয়ার সাড়ে চার ঘণ্টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার (১৯) লাশ উদ্ধার করা হয়। নানা হাজি জামালের হাত থেকে ছুটে নালায় পড়ে যান তিনি। সেই কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন নানা। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকায় অবস্থিত নিজ বাড়িতে

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এম জহিরুল আলম দোভাষ দাবি করেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে অনেক জায়গায় সিটি করপোরেশনের নালা ছিল না। যেসব নালা ছিল, তা–ও অপর্যাপ্ত ও অপ্রশস্ত। এখন সিডিএর পক্ষ থেকে নালা নির্মাণ করা হচ্ছে, সংস্কার করা হচ্ছে। আর রাস্তায় গর্ত থাকলে তা দ্রুত ভরাট করে দেওয়া হচ্ছে।

তবে সিডিএ চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, পরস্পরের দোষ খুঁজে লাভ নেই। নগরবাসীর স্বার্থে এবং ভবিষ্যতে যাতে নালা-খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে, সেদিকে নজর দিতে হবে। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন কোনো পরামর্শ চাইলে সিডিএর পক্ষ থেকে দেওয়া হবে। আর যেসব খাল ও নালায় সিডিএর প্রকল্প চলছে, সেখানে কাজ শেষে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়া হবে।

দুই সংস্থার ভূমিকায় ক্ষোভ

দীর্ঘদিন ধরে নালা উন্মুক্ত থাকলেও তাতে নিরাপত্তাবেষ্টনী দেওয়ার বিষয়ে কারও কোনো নজর ছিল না। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, নালার দুই পাশে আমগাছের ডাল দিয়ে প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়েছে। পরে তা সরিয়ে সেখানে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঘেরাও দেন সিটি করপোরেশনের লোকজন।

আরাফাত হোসেন নামের এক পথচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন এসব (বেড়া-বাঁশ) দিয়ে কী হবে। আগে দিলে তো মেয়েটি মারা যেত না। এই নালায় আগেও লোকজন পড়ে ছিল। তাঁরা কোনোরকমে বেঁচে এসেছে।

মন্টু দত্ত নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, নালার পাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকলে মেয়েটি বেঁচে যেত। এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। তাই সিডিএর উচিত ছিল নালার পাশে ঘেরাও দেওয়ার। আর সোমবার বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে কাদা হয়ে যায়। চলাচল করা যায় না। ফলে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটি স্লিপ করে নালায় পড়ে গেছে।

পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত, এই ঘটনার জন্য সিডিএ ও সিটি করপোরেশন সমান দায়ী। এখানে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের অবহেলার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

দায়ীদের শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার মিডটার্ম পরীক্ষা চলছে। মঙ্গলবার ছিল তাঁর তৃতীয় পরীক্ষা। তাঁর মৃত্যুতে স্থগিত করা হয় এই পরীক্ষা। এমন মৃত্যুতে শোকাহত শেহেরীনের শিক্ষক ও সহপাঠীরা।

মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থলে এসে মানববন্ধন করেন তাঁর সহপাঠীরা। পরে নগরের বাদামতল মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এ সময় সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের দাবি জানান। প্রায় আধা ঘণ্টা সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ এসে অনুরোধ করে তাঁদের সরিয়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান তানবীর আহসান বলেন, সম্ভাবনাময়ী একজন ছাত্রীর এভাবে মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।