চলতি বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া মো. আমির হামজা খুনের মামলায় আসামি ছিলেন। মাগুরার শ্রীপুরের বরিশাট গ্রামে ১৯৭৮ সালে খুনের ওই ঘটনা ঘটে। ওই মামলায় মো. আমির হামজাসহ ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। নিহত ব্যক্তির স্বজন ও দণ্ডিত অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তবে খুনের মামলার আসামি হওয়ার কথা স্বীকার করলেও সেই মামলায় আমির হামজার দণ্ড পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন তাঁর বড় ছেলে মো. আলী মর্তুজা।
গত মঙ্গলবার ঘোষণা করা হয় স্বাধীনতা পুরস্কার। এ বছর ১০ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মরহুম আমির হামজাও আছেন।
সাহিত্যে তাঁর পুরস্কার পাওয়ার ঘোষণা নিয়ে গতকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা ক্ষেত্রে বিতর্ক ওঠে। দেশের সাহিত্য অঙ্গনে তিনি একেবারেই পরিচিত নয়। স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো সাহিত্যকর্ম করার নজিরও নেই। ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে আমির হামজা মারা যান। এখন তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলার সাজা পাওয়ার কথা জানা গেল।
জানতে চাইলে জাতীয় পুরস্কারসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি খুনের মামলায় আমির হামজার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি শুনেছি। এ নিয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে।’
মো. শাহাদাত হোসেন ফকির নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন আমির হামজা। ওই ব্যক্তির বাড়ি আমির হামজার গ্রাম শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট পূর্ব পাড়ায়। ১৯৭৮ সালে (১৩৮৫ বাংলা সনের ৩০ আশ্বিন) জমির ধান কাটা নিয়ে বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন শাহাদত ফকির।
নিহত শাহাদত ফকিরের ছেলে মো. দিয়ানত আলী ফকিরের (৬৪) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যা মামলার প্রায় সাত বছর পর ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন মো. আমির হামজা, তাঁর ভাই গোলাম রব্বানী সরদার, হাসেম মোল্লা, নুরুল মোল্লা, ওমেদ চৌধুরী ও আফজাল মোল্লা। তাঁদের সবার বাড়ি বরিশাট গ্রামে।
দিয়ানত আলী ফকির গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিদের কারাদণ্ড হলেও পাঁচ–সাত বছর পর ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের সাধারণ ক্ষমা পেয়ে সব আসামি বেরিয়ে যান। আমরা দরিদ্র মানুষ। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। তাই এ নিয়ে কিছু করতে পারিনি।’
ওই মামলায় আসামিদের মধ্যে মো. আমির হামজা ও তাঁর ভাই গোলাম রব্বানীসহ কয়েকজন মারা গেছেন। তবে দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে একজন আফজাল মোল্লা (৮০) এখনো বেঁচে আছেন। গতকাল বরিশাট গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শাহাদত হোসেন ফকির হত্যা মামলায় মো.আমির হামজা, সরদারসহ ছয়জনের কারাদণ্ড ভোগ করার বিষয়টি স্বীকার করেন আফজাল মোল্লা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমি আসামি হই। প্রায় নয় বছর জেল খাটার পর ১৯৯১ সালে আমির হামজাসহ অন্যদের সাথে ছাড়া পাই।’
এ দুই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মো. শাহাদত হোসেন ফকির যেদিন মারা যান, একই দিনের সংঘর্ষে আড়াই বছর বয়সী এক শিশুও নিহত হয়। নিহত ওই শিশুর নাম ছিল শিল্পিনা। সে বরিশাট গ্রামের মো. গোলাম কিবরিয়া ওরফে শাবান মোল্লার (৭৩) মেয়ে।
শাবান মোল্লা জানান, ঘটনার দিন তাঁর মেয়ে নানাবাড়িতে (একই গ্রাম) ছিল। মারামারি চলাকালে নানির কোলে থাকা অবস্থায় শিশু শিল্পিনার পাঁজরে সড়কি বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় শিশুটি। শাবান মোল্লা জানান, তাঁর মেয়ে হত্যার ঘটনায়ও মো. আমির হামজাসহ ওই ছয়জনকে দণ্ড দেন আদালত। তবে এ মামলায় আমির হামজাসহ অন্যরা অভিযুক্ত ছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন জায়গায় গানবাজনা ছাড়াও ব্যবসা ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আমির হামজা। তিনি অন্তত দুই মেয়াদে শ্রীকোল ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সদস্য ছিলেন। জেলার সক্রিয় কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটা সময় বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আমির হামজা। ওই সময় মাগুরায় বিএনপির এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। স্থানীয় অনেকের ধারণা, ওই মন্ত্রীর ‘তদবিরেই’ জেল থেকে ছাড়া পান আমির হামজাসহ অন্যরা।
আমির হামজা সম্পর্কে জানতে চাইলে মাগুরা জেলা বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর (আমির হামজা) একটা দারুণ গুণ ছিল। যেকোনো অনুষ্ঠানে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনা অতিথিকে নিয়ে গান গাইতে পারতেন। একসময় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অনেক গান গেয়েছেন।
খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে মো. আমির হামজার বড় ছেলে মো. আলী মর্তুজা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মামলার আসামি হয়েছিলেন এবং কিছুদিন জেল খেটেছিলেন। তবে খালাস পেয়ে যান। মিথ্যা অভিযোগে মামলা হয়েছিল। গ্রামে এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা প্রায়ই ঘটে।
শাহাদত হোসেন ফকির হত্যা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুকদেব রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এত বছর আগের ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। থানায় এত পুরোনো মামলার নথি আছে কি না, খুঁজে দেখতে হবে।