কিশোর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার আবু বকর সিদ্দিক। পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিলেও কৃষি ছাড়েননি। দুই দশক ধরে শাকসবজি চাষ করে পেয়েছেন সাফল্য। এবার বিদেশি ফল সাম্মাম ফল চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আবু বকর। তাঁর পরামর্শে কৃষিতে সফলতার দেখা পাচ্ছেন আরও অনেকে।
ইউটিউবে প্রথম এই ফল চাষ সম্পর্কে জানতে পারেন আবু বকর। বিদেশি এই ফলের পুষ্টিগুণ অসাধারণ। ফলটিতে আছে নানা ঔষধি গুণ। এই ফল সর্দি-কাশি দূর করে। পরিপাকজনিত সমস্যা সমাধান করে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। উপরন্তু বাজারে এই ফলের দামও বেশি পাওয়া যায়। তাই এই ফল চাষ লাভজনক হওয়ায় এ বিষয়ে আগ্রহী হন তিনি। গত বছর পরীক্ষামূলক অল্প জমিতে সাম্মাম চাষ করেছিলেন আবু বকর। লাভজনক হওয়ায় এ বছর এক বিঘা জমিতে সাম্মাম চাষ করেন।
সাম্মাম গ্রীষ্মকালীন ফল। গত ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাম্মামের বীজতলা তৈরি করেন আবু বকর। এরপর বীজতলায় তৈরি চারা বেড তৈরি করে রোপণ করেন। তাঁর খেতে ১ হাজার ১০০ চারা রয়েছে। চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে ফল আসে। প্রতিটি চারায় দুটি থেকে তিনটি ফল হয়। একটি সাম্মাম এক থেকে আড়াই কেজি পর্যন্ত ওজনের হয়। প্রতি কেজি রাজধানীতে দেড় শ টাকায় বিক্রি হয়। আবু বকরের এক বিঘা জমিতে সাম্মাম চাষে খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ফলন ভালো হওয়ায় বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।
যেভাবে শুরু
ভান্ডারিয়া উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারে আবু বকরের জন্ম। ১৯৯৪ সালে বিএ পাস করে পূর্ব মাটিভাঙ্গা মোন্তাজিয়া দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। তখন বেতন ছিল ১ হাজার ৭৩৫ টাকা। বেতনের টাকায় পরিবারের খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। এ সময় বাড়তি আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা তাঁকে কৃষিকাজের পরামর্শ দেন।
শুরুতে আবু বকর বর্গাচাষি হিসেবে কলার চাষ দিয়ে শুরু করেন। এরপর কলা, কুল, আখ ও মৌসুমভিত্তিক শাকসবজি চাষ শুরু করেন। কৃষিকাজের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যে সাফল্য আসে। সফলতা দেখে স্থানীয় কৃষকেরা তাঁর পরামর্শ নিয়ে সবজি চাষে ঝোঁকেন। ২০০৯ সালে কৃষক মাঠ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় এলাকার কৃষক ও বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন আবু বকর। ২০১৭ সালে আদর্শ কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান তিনি।
আবু বকর নানা ধরনের ফসল ও সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। তিনি লালশাক, পুঁইশাক, করলা, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়সসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি কৃষিকাজ করে বছরে চার লাখ টাকা আয় করছেন।
এ বছর ছয় বিঘা জমিতে তরমুজ ও গ্রীষ্মকালীন নানা জাতের সবজি চাষ করেছেন আবু বকর। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার অন্তত ১৫ কৃষক সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন।
আজ বুধবার সকালে ভান্ডারিয়া উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামে কৃষক আবু বকর সিদ্দিকের খেতে গিয়ে দেখা যায়, সাম্মাম পাকা শুরু করেছে। আবু বকর সিদ্দিক ও কয়েকজন কৃষক পাকা সাম্মাম কাটছেন।
আবু বকর সিদ্দিক বলেন, গতকাল বুধবার সকালে আমি খেতের পাকা সাম্মাম কাটা শুরু করেছি। এক হাজার কেজি কাটা হয়েছে। এগুলো ট্রাকে করে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হবে। প্রতি কেজি ১৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করা যাবে বলে তিনি জানান। এক সপ্তাহের মধ্যে খেতে সব সাম্মাম কাটা শেষ হবে।
মাটিভাঙ্গা গ্রামের জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আবু বকর সিদ্দিককে দেখে আমি শীত ও গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হই। আমাদের গ্রামের অনেক কৃষক তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়ে শাকসবজি ও তরমুজ চাষে সফলতা পেয়েছেন।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, আবু বকর একজন পরিশ্রমী কৃষক। তিনি যে কাজ শুরু করেন, সেটা নিয়ে লেগে থাকেন। তরমুজ চাষে সফলতার পর তিনি সাম্মাম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। তাঁর খেতে রকমেলনের ভালো ফলন হয়েছে। পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এ ফল চাষে কৃষি বিভাগ তাঁকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছে।