সানজানার হাতে পুঁচকো নম্বর ৪২৮...

দুই পুঁচকো কোলে সানজানার পোজ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
দুই পুঁচকো কোলে সানজানার পোজ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

পুঁচকো নম্বর ৪২৮, ছেলে-ওজন ৩.৮ কেজি, মা ও বাচ্চা ভালো আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে নম্বরে হেরফের করতে হয়। একবার একসঙ্গে লিখতে হলো, পুঁচকো নম্বর ৪২৫ ও ৪২৬। যমজ ছেলে বাচ্চা। একজনের ওজন ১.৯ কেজি, আরেকজনের ২ কেজি। কোনো কোনো পুঁচকোর নম্বরের পাশে লেখা, স্বামী বউকে হাসপাতালে রেখেই বাড়ি চলে গেছেন। মা ও বাচ্চার অবস্থা খারাপ ছিল। কোনোটাতে লেখা, পেটের মধ্যে বাচ্চার গলায় নাড়ি প্যাঁচানো ছিল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এভাবেই বিবরণ লিখে রাখেন সানজানা শিরিন। এই নম্বরগুলো হলো, অস্ত্রোপচার ছাড়া স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া নবজাতকের। আর এই স্বাভাবিক প্রসবে মাকে সহায়তা করেন সানজানা শিরিন।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন পরিচালিত হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ নার্স হিসেবে কাজ করছেন সানজানা। ১৭টি চা-বাগানের চা–শ্রমিকদের চিকিৎসা দেয় এই হাসপাতাল। ১৭টি চা–বাগানে মিডওয়াইফ আছে। তাঁদের রেফার করা রোগীরা আসেন এ হাসপাতালে। হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবে কোনো টাকা লাগে না। তাই সানজানা আপ্রাণ চেষ্টা করেন স্বাভাবিক প্রসব করানোর। জটিল হলে বাধ্য হয়ে তা অস্ত্রোপচারের জন্য রেফার করে দেন। গত তিন বছরে পুঁচকো নম্বর ৪২৮ হয়েছে, অর্থাৎ সানজানার হাতে ৪২৮টি নবজাতকের জন্ম হয়েছে।

২৭ মে পুঁচকো নম্বর ৪২৮–এর সঙ্গে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন সানজানা। একেকটি নবজাতক কান্নার মাধ্যমে পৃথিবীতে তার উপস্থিতি জানান দেয়, আর কাপড়ের পুঁটলিতে নিয়ে সানজানা হাসিমুখে সেলফি তুলে পোস্ট দেন।

সানজানার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। স্বাভাবিক প্রসব করানোর অনুভূতির কথা জানতে চাইলে সানজানা তাঁর ভাষায় বললেন,‘বাচ্চা হওনের আগে ব্যথায় মা লাথি মাইরা ফালায়ও দেয়। চিল্লাপাল্লা করে। আমিও চিল্লাপাল্লা করি। তবে বাচ্চা হওনের পর বলে, দিদি তুই আমার ভগবান, আমার জীবন বাঁচাইছস। এই কথা বইল্লা মা কী যে সুন্দর হাসি দেয়।’

হাসপাতালেই বিনা মূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন সানজানা। জানালেন, এখানে আসা রোগীদের বেশির ভাগই হতদরিদ্র। সন্তান প্রসবের পর মাকে যে কিছু খেতে দেবে, অনেকের সে প্রস্তুতিও থাকে না। তখন সানজানা নিজের জন্য রাখা ভাত-তরকারি এনে দেন ওই মাকে।

সানজানা স্বাভাবিকভাবে প্রসব করানোর প্রথম অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, তখন তিনি কাজ করতেন মৌলভীবাজার সদরে। রাতে বিদ্যুৎ ছিল না। মুঠোফোনের লাইট জ্বালিয়ে প্রসব করাতে হয়।

সানজানার হাতে এখন পর্যন্ত তিনটি নবজাতক মারা গেছে প্রসব করানোর সময়। তবে সানজানা বললেন, রোগীর স্বজনকে জানানো হয়েছিল বাচ্চার অবস্থা ভালো না, রেফার করতে হবে। তবে স্বজনেরা তাতে রাজি হননি। কেননা, অস্ত্রোপচার করে সন্তান বের করতে তো অনেক টাকা লাগে। আর এই পর্যন্ত একজন মা–ও মারা যাননি বলে কিছুটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন সানজানা। তবে একজন মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলেও জানালেন তিনি।

চা–শ্রমিকদের এক বেলা খাবারের আয়োজনে সানজানার প্রচেষ্টা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সানজানারা ৬ বোন, ২ ভাই। বাবার মুদির দোকান আছে। কিছু কৃষিজমি আছে, যা থেকে সারা বছর খাওয়ার চাল পাওয়া যায়। এক বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই এখন সংসারের দেখভাল করছেন। অন্য ভাইবোনেরা হয় চাকরি না হয় পড়াশোনা করছেন। সানজানা নিজের খরচে এক বোনকে নার্সিং পড়াচ্ছেন।

সানজানা বেশ আক্ষেপ নিয়েই জানালেন, পরিবারের অসহযোগিতার কারণে পড়াশোনা করে এ পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে বড় ভাই চাননি সানজানা লেখাপড়া করুক। বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এমনও হয়েছে, সানজানা পড়তে বসেছেন, সেখান থেকে নিয়ে কাজ ধরিয়ে দেওয়া হতো। পরিবারের কাছে এখন পর্যন্ত সানজানার বিয়েটাই প্রাধান্য পায়। তাই সংগ্রাম চলছেই।

এইচএসসি পরীক্ষার সময় ম্যাটসের (মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল) একটি লিফলেট পান সানজানা। কিন্তু ভর্তি হতে নানান সমস্যা। পরে বাবা ভর্তি করিয়ে দেন। একসময় পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হলে সানজানা আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলেন। তবে এখন এ কারণে লজ্জিত তিনি। বললেন, সৎ এবং কঠোর পরিশ্রম করলে জীবনটা আসলে খুব সুন্দর। আর নতুন নতুন নবজাতকের জন্মের পর ভালো লাগার যে অনুভূতি তা থেকেও তো তিনি বঞ্চিত হতেন আত্মহত্যা করলে।

সানজানা শুধু যে স্বাভাবিক প্রসবে সহায়তা করছেন তা তো নয়। সেই ২০১৪ সাল থেকে দরিদ্র রোগীর জন্য রক্ত সংগ্রহে নেমেছেন। ফেসবুকে রক্ত চেয়ে প্রায় প্রতিদিনই পোস্ট দেন। রক্ত পেতে যতভাবে সহায়তা করা দরকার, তা করেন। রক্ত সংগ্রহে কখনো কখনো নিরাশ হলেও থেমে থাকেন না। রক্তের গ্রুপ জানা আছে এমন পরিচিত মানুষকে ফোন করেন।

রক্ত সংগ্রহের বাইরে পথশিশুদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানান কাজে ব্যস্ত সানজানা। পরিচিত কোনো বড় ভাই বা বোন বিয়ে করেছেন, তাঁরা ভালো কাজে কিছু টাকা ব্যয় করতে চান। টাকা পাঠিয়ে দেন সানজানার কাছে। সানজানা কোনো বৃদ্ধ নারীর ঘরে খাবার নেই অথবা চা–শ্রমিকদের এক বেলা খাবারের আয়োজনে মাঠে নামেন। বাজার করা, রান্না করা থেকে শুরু করে সব কাজে হাত লাগিয়ে দরিদ্র মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটিয়ে তবে ছুটি। যে ভাই বা বোন টাকা পাঠিয়েছিলেন তাঁদের পুরো কাজের ফিরিস্তি দেন। দরিদ্র মানুষগুলো যিনি টাকা পাঠিয়েছেন তাঁর জন্য যেমন দোয়া করেন, তেমনি দোয়া করেন তাঁদের সানজানা দিদির জন্য। তাই তো সানজানা অসুস্থ হলে দরিদ্র মানুষগুলোই এক বোতল দুধ বা গাছের কোনো ফল নিয়ে হাজির হন সানজানার কাছে।

সানজানা বললেন, ‘আমার নিজের জন্য কোনো সময় নাই। আমি মনে করি, আমি এখন যে কাজগুলো করি, পরে আর তা করতে পারব না। তাই যত দিন পারি করে নিই।’

সানজানার স্বপ্ন একটি বৃদ্ধাশ্রম বানানোর। যাঁদের ছেলে বা মেয়ে নেই, স্ত্রী বা স্বামী নেই—অর্থাৎ একেবারেই অসহায় বৃদ্ধদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম বানাবেন। একটি স্থায়ী চাকরি পেলে এখন থেকেই তিনি এ স্বপ্ন পূরণে নামবেন বলে জানালেন।