সাত খুনের সাত বছর, রায় কার্যকরের প্রতীক্ষায় স্বজনেরা

বাবার ছবি হাতে শিশু রওজা। তার বাবা গাড়ি চালক জাহাঙ্গীর আলম সাত বছর আগে হত্যার শিকার হন। তখনো রওজার জন্মই হয়নি। মঙ্গলবার সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় তোলা।
ছবি: দিনার মাহমুদ

রওজার বয়স এখন ৬ বছর ১০ মাস। বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে দেখেনি সে। কেউ বাবার কথা বললে বাঁধাই করা বাবার ছবিটা ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে সে। ছবিতে চুমু দেয়, আদর করে। ছবির বাবার সঙ্গেই কথা বলে সে।

জাহাঙ্গীর আলম গাড়ি চালাতেন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল তিনিসহ সাতজন ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। তিন দিন পর শীতলক্ষ্যায় সাতজনেরই লাশ ভেসে ওঠে। ‘নারায়ণগঞ্জের সাতখুন’ হিসেবে ঘটনাটি সারা দেশে ব্যপক আলোচিত হয়।

ওই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর আলম, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিম হোসেন।

এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা করেন। আলোচিত এ হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাব-১১ চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন আদালত। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন।

সাত খুনের একটি মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির সঙ্গেও কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাত বছরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হয়নি। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার পর আসামীপক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছেন। বর্তমানে মামলাটি আপিল শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা চাই দ্রুত রায় কার্যকর করা হোক।’

বলা যায় বর্তমানে মামলাটি ডিপ ফ্রিজে আছে। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল শুনানির জন্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। আমরা চাই, মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক এবং রায়টি কার্যকর করা হোক।
সাখাওয়াত হোসেন, মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি

নিহত যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামানের ভাই রিপন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের রক্ষক যারা, তাদের হাতে সাতজন মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের সাত বছরেও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। আমরা চাই দ্রুত বিচার রায় কার্যকর করা হোক।’ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিশন শুনানির অপেক্ষায় আছে। বলা যায় বর্তমানে মামলাটি ডিপ ফ্রিজে আছে। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় আপিল শুনানির জন্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। আমরা চাই, মামলাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক এবং রায়টি কার্যকর করা হোক।’

জীবিকার সংকটে পরিবারগুলো
হত্যার শিকার হওয়া এই ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের নিহত হওয়ার পর পরিবারগুলো জীবিকার সংকটে পড়েছে মারাত্মকভাবে।

গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের পরিবারটিকেও জীবিকার জন্য এখনো লড়ে যেতে হচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী মধ্যাপাড়া এলাকার বাসায় জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী সামসুন্নাহার নূপুর ও মা মেহেরুন নেসার সঙ্গে কথা হয়। কথার মাঝেই জাহাঙ্গীরের মেয়ে রওজা বলছিল, ‘বাবাকে র‌্যাবের লোকেরা মারছে।’ শিশুটির এই কথায় চোখ ছলছল করে ওঠে অন্যদেরও। বন্ধুদের কেউ কিছু বললেই শিশুটি বাবার সেই ছবি বুকে নিয়ে কান্না শুরু করে বলে জানালেন সামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কোনো শেষ নেই। একটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে এত আলোচনা হলো, অথচ সাত বছরেও রায় কার্যকর হয়নি। সাত বছর ধরে সংসার চালাতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।’

কেউ বাবার কথা বললেই কান্না পায় রওজার। দাদিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে রওজা। মঙ্গলবার সিদ্ধিরগঞ্জের বাসা থেকে তোলা।

জানা গেল, সিটি মেয়র আইভী সিটি করপোরশেনে মাস্টাররোলে ছয় হাজার টাকা বেতনের অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি দিয়েছেন সামসুন্নাহারকে। সেই টাকাতেই কোনো রকমে তিনজনের সংসারটি চলে। কিন্তু সেই চাকরিটিও স্থায়ী হয়নি।

এদিকে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের উপার্জনক্ষম লোকটিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবারটিও। চরম অর্থসংকটে দিনাতিপাত করছেন।

নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সহযোগী তাজুল ইসলামের পরিবারটিও পড়েছে আর্থিক সংকটে। তাঁর বাবা আবুল খায়ের প্রথম আলোকে বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় এখনো কার্যকর হয়নি। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের একটাই দাবি, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার শেষ হোক। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার দাবিও জানান আবুল খায়ের।