নীলফামারীর সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী মুর্তজা ইনস্টিটিউট
নীলফামারীর সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী মুর্তজা ইনস্টিটিউট

সাংস্কৃতিক চর্চার মিলনায়তন এখন গুদাম

মিলনায়তনটি একসময় ছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরের মানুষের সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বদলে গেছে ঐতিহ্যবাহী মিলনায়তনটির চিত্র। এটি এখন একজন কাপড় ব্যবসায়ীর দখলে। ভাড়া নিয়ে মিলনায়তনের তিনটি কক্ষ ঝুট কাপড়ের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন তিনি। সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গাটি হারিয়ে ভীষণ হতাশ সৈয়দপুরের সংস্কৃতিকর্মীরা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের চিত্তবিনোদনের জন্য গড়ে তোলা হয় একটি মিলনায়তন। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত মিলনায়তনটির নাম ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব। পরবর্তী সময়ে এটির নামকরণ করা হয় মুর্তজা ইনস্টিটিউট। এতে রয়েছে মঞ্চসহ ৫০০ আসনের একটি দ্বিতল মিলনায়তন। রয়েছে টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, গ্রন্থাগার, গ্রিনরুম, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ, মহড়াকক্ষ, কর্মকর্তাদের কার্যালয়সহ আরও কয়েকটি কক্ষ। বিশাল ওই মিলনায়তনজুড়ে সৈয়দপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তখন মুখর ছিল।

মুর্তজা ইনস্টিটিউট এখন ঝুট কাপড়ের গুদাম

সরেজমিন দেখা যায়, মিলনায়তনটির মহড়াকক্ষ, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও গ্রিনরুমটি রয়েছে এক ভাড়াটে ব্যবসায়ীর দখলে। গত ডিসেম্বর মাসে মো. নাদিম নামের এক ঝুট কাপড় ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাজার টাকায় কক্ষগুলো ভাড়া দেওয়া হয়। পুরো মিলনায়তন অন্ধকারাচ্ছন্ন। এর মধ্যেই থরে থরে কাপড়ের গাঁটরি রাখছেন শ্রমিকেরা। গ্রিনরুমে চলছিল চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার কাজ। অন্য রুমগুলোতে মজুত করা হয়েছে ঝুট কাপড়। ভাড়াটে ব্যবসায়ী নাদিম বলেন, ‘মুর্তজা ইনস্টিটিউটে এখন কোনো গানবাজনা হয় না। তাই আমি এর কয়েকটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছি।’

মুর্তজা ইনস্টিটিউটের গ্রিনরুম এখন রান্না ঘরে পরিণত হয়েছে

মুর্তজা ইনস্টিটিউটের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেলওয়ে কর্মকর্তা তহিদুল ইসলাম জানান, ‘কোভিডকালে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। মুর্তজার সদস্যদের জন্য এর মধ্যেও খেলাধুলার আয়োজন করেছি। ওই খেলাধুলার ব্যয় নির্বাহের জন্য কয়েকটি কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্তে এমনটি করেছি আমরা। সাংস্কৃতিক পরিবেশ স্বাভাবিক হলে ভাড়াটে সরিয়ে দেওয়া হবে।’

সাধারণ সম্পাদকের এমন যুক্তিকে অপ্রাসঙ্গিক দাবি করেছেন রেলওয়ের একাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। তাঁরা বলেন, মুর্তজা ইনস্টিটিউটের ১৯টি দোকানঘর রয়েছে। এসব দোকানঘরের ভাড়া প্রতিষ্ঠানটির আয়ের উৎস। এর ভাড়া দিয়েই সব অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সৈয়দপুর থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ও বিনোদন পাক্ষিক আনন্দ আলোর সম্পাদক রেজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সৈয়দপুর শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এই মিলনায়তন ঘিরে। এটি একজন ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দেওয়ায় কষ্ট পাচ্ছেন বলে জানালেন রেজানুর।

সৈয়দপুর থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা রেজানুর রহমান বলেন, ‘মিলনায়তনটি ভাড়া দেওয়ায় সৈয়দপুরের সাংস্কৃতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালেও মুর্তজা ইনস্টিটিউটে নাট্য উৎসবের আয়োজন করেছিলাম আমরা। ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক নাট্যদল তাদের সেরা নাটক মঞ্চায়ন করেছে এ মিলনায়তনে।’

চোখ নাট্যদলের সভাপতি ঈশা আলী বলেন, তাঁরা মুর্তজার মঞ্চে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন। নাট্য উৎসব হয়েছে, বইমেলা, পিঠা উৎসব, গুণীজন সংবর্ধনাসহ কত কিছু। দেশের বরেণ্য শিল্পীরা এ মঞ্চে অভিনয় করেছেন, যা এখন সোনালি অতীত। সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী মুর্তজা ইনস্টিটিউটটি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ভাড়াটে লোকজন মঞ্চের পাশে গ্রিনরুমে আগুন জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করছেন। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন জানান, প্রতিষ্ঠানটি রেলওয়ের সম্পদ হলেও এটি ছিল সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুর্তজা ইনস্টিটিউট। নাটক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াও এখানে চলত রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশ। প্রতিষ্ঠানটি ভাড়া দেওয়ায় এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে।