নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত তরুণ সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন ওরফে মুজাক্কির হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও উপযুক্ত বিচার দাবি করেছে তাঁর পরিবার। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সহিদ উদ্দিন এস্কান্দার মিলনায়তনে পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিহত বুরহান উদ্দিনের বাবা নুরুল হুদা ওরফে নোয়াব আলী মাস্টার, মা মমতাজ বেগম, বড় ভাই নুর উদ্দিন মুহাদ্দিস, মেজ ভাই মো. ফখরুদ্দিন মোবাচ্ছির, বড় বোন জান্নাতুল ফেরদাউস, গোলশান আরা বেগম, গোলনাহার বেগম, ভগ্নিপতি আবদুস সাত্তার প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে নুর উদ্দিন মুহাদ্দিস বলেন, ‘স্বজন হারানোর বেদনা বিশেষ করে আদরের ছোট ভাইবোন, ছেলেমেয়ে হারানোর কষ্ট কত যন্ত্রণাদায়ক, তা যিনি হারিয়েছেন, একমাত্র তিনিই বোঝেন। মনে পড়ে যায় ১৫ আগস্টের কথা। হায়েনারা কত নির্দয়–নিষ্ঠুরভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছোট ভাই শেখ রাসেলকে হত্যা করেছিল। আজকে আমরা শোকাহত অবস্থায় আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি, আমাদের প্রাণপ্রিয় বুরহানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে।’ তিনি আরও বলেন, সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার বিচার আজও হয়নি। তাই তাঁরা চান বুরহান হত্যার বিচারও যেন সাগর-রুনি হত্যার বিচারের মতো দীর্ঘায়িত না হয়। প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেন তাঁরা।
বুরহান হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা প্রত্যাশা করে নুর উদ্দিন মুহাদ্দিস বলেন, ‘বুরহান উদ্দিন হত্যা মামলাটি ইতিমধ্যে পিবিআইতে স্থানান্তর হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’
ছেলে হারানোর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বুরহানের মা মমতাজ বেগম ও বাবা নুরুল হুদা। মমতাজ বেগম বলেন, ‘কী অপরাধ ছিল আমার মুজাক্কিরের। তারা কেন এভাবে নির্মমভাবে আমার ছেলেকে গুলি করেছে। আমার ছেলে তো কখনো কারও ক্ষতি করেনি। সব সময় মানুষের ভালোর জন্য ঘুরে বেড়িয়েছে।’
বাবা নুরুল হুদা বলেন, ‘বুরহান পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। এই অল্প বয়সে সে ২৬ বার রক্ত দিয়েছে। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এভাবে রক্ত দিলে নিজে বাঁচবে কীভাবে? জবাবে সে আমাকে বলে, “আব্বা, আমার বাঁচার দরকার নেই। আমার গ্রুপের রক্ত (এ-নেগেটিভ) ঠিকমতো পাওয়া যায় না। আমার রক্তে যদি একটা মানুষের জীবন বাঁচে, সেটাই আমার লক্ষ্য।’
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জার মিথ্যাচারের প্রতিবাদে গত শুক্রবার বিকেলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল। বাদলের মিছিলটি বিকেল পাঁচটায় বাজার-সংলগ্ন তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে চাপরাশিরহাট মধ্যম বাজারে গেলে কাদের মির্জার অনুসারীরা হামলা চালান। এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশ দুই পক্ষকে দুই দিকে ধাওয়া করে এবং ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর কাদের মির্জার নেতৃত্বে তাঁর শতাধিক অনুসারী মোটরসাইকেল ও গাড়িতে করে চাপরাশিরহাট এলাকায় যান। একপর্যায়ে কাদের মির্জার সমর্থকেরা বাজার-সংলগ্ন মিজানুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও গুলি চালান। এ সময় দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক বুরহান গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে তাঁর মুখের নিচের অংশ এবং গলা ঝাঁজরা হয়ে যায়। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন আরও ছয়জন। ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন বুরহানসহ আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় নেওয়া হয় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে। এরপর রাতেই বুরহানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার বুরহানের বাবা নুরুল হুদা বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তবে মামলার এজাহারে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আসামির নাম উল্লেখ করেননি।