ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়কে উন্নীতকরণের চলমান কাজের ফলে ওই এলাকার আশুগঞ্জ পলাশ-অ্যাগ্রো ইরিগেশন সেচ প্রকল্পের (সবুজ প্রকল্প) খালের তিন–চতুর্থাংশ ভরাট হয়ে গেছে। এর ফলে সরাইলে সেচ প্রকল্পের পানিসংকট দেখা দিয়েছে। এতে সরাইল উপজেলার ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান চাষ হুমকিতে পড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৬৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০ কিলোমিটার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ চলছে। এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিবেশী দেশকে ট্রানজিট–সুবিধা দেওয়া হবে। মহাসড়কের সম্প্রসারণ কাজের জন্য আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ১০ কিলোমিটার অংশে খালের তিন-চতুর্থাংশ ভরাট হয়ে গেছে। আগে ৩০-৪০ ফুট প্রশস্ত খাল দিয়ে সেচ প্রকল্পের পানি প্রবাহিত হতো। এখন খালটি মাত্র চার-পাঁচ ফুট প্রশস্ত হয়ে পড়ায় খুব অল্প পরিমাণ পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া খালের গভীরতাও কমে গেছে। স্থানে স্থানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানিপ্রবাহ। এতে সেচ প্রকল্পের (সবুজ প্রকল্প) অধীন সরাইল উপজেলার ১০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান চাষের সুষ্ঠু ফলন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
আগে মহাসড়কের পাশের এই খাল দিয়ে পানি প্রথমে জাফর খালে প্রবাহিত হতো। এরপর জাফর খালের সঙ্গে যুক্ত বোয়ালিয়া, নাইজুর, লাহুর, বুড্ডা ও উত্তরের খাল হয়ে সরাইল উপজেলার সদর, পানিশ্বর, কালীকচ্ছ, নোয়াগাঁও, চুন্টা ও শাহবাজপুর ইউনিয়নের ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হতো। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কৃষক। গত ৪০ বছর ধরে আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্পের পানি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষ করে আসছেন।
৬, ৭ ও ৮ মার্চ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পানিশ্বর ইউনিয়নের পানিশ্বর, বিটঘর, বেড়তলা, নাইলা, সদর উপজেলার কুট্টাপাড়া, সৈয়দটুলা, চুন্টা ইউনিয়নের রসুলপুর, চুন্টা বড়বল্লা এলাকায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে। সবুজ প্রকল্পের প্রধান খাল কুট্টাপাড়া অংশের পর নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইসলামাবাদ থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত খালটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। ওই খালের প্রায় ছয় কিলোমিটার অংশে কোনো পানি নেই। এ অংশে অন্তত ২৫টি সেচ পাম্প সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। পানিস্বল্পতার কারণে বহু সেচপাম্প বিকল হয়ে গেছে। এতে বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা খরচ করে স্থানে স্থানে অনেক অগভীর সেচপাম্প (শ্যালো মেশিন) বসিয়েছেন। এ বছর খাল ভরাটের কারণে কৃষকেরা সঠিক সময়ে ধানের চারা রোপণ করতে পারেননি। অন্যদিকে সঠিক মাত্রায় পানিও পাচ্ছেন না। এতে কৃষকেরা ধানের সঠিক উৎপাদন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
ইসলামাবাদ গ্রামের কৃষক কুদরত আলী, আবদুল আলীম, আঞ্জির আলী, কুট্টাপাড়া গ্রামের আহামদ আলী জানান, তাঁরা জমিতে পানি দিতে পারছেন না। শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক আলিম মিয়া বলেন, ‘৭ কানি (৩০ শতক = ১ কানি) জমিতে ধান চাষ করছি। সবুজের পানি না পাইয়া স্কিম ম্যানেজার সেলু (শ্যালো মেশিন) বসাইছে। তাতেও পানি দেওয়া যাইতেছে না। গত ১৭ দিন ধইরা জমিতে পানি নাই।’ সরাইল উপজেলার ইসলামাবাদ গ্রামের কৃষক আফতাব মিয়া বলেন, ‘সেচ প্রকল্পের অধীন আমার তিনটি সেচপাম্প রয়েছে। খালে পর্যাপ্ত পানি থাকায় আমার দুটি সেচপাম্প বিকল হয়ে গেছে। ২০০ কানির বেশি আবাদি জমি নিয়ে বিপাকে পড়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো সুরাহা পাচ্ছি না।’
প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে ওই প্রকল্পের পানিপ্রবাহ শুরু হয়। খাল ভরাট হওয়াতে যথাসময়ে পানিপ্রবাহ শুরু না হওয়ায় গত ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার উদ্যোগে মহাসড়কের পাশে খাল কাটার দাবিতে কৃষক সমাবেশ করে। এরপর তড়িঘড়ি করে ১৫ জানুয়ারির পর পানিপ্রবাহ শুরু হয়।
সরাইল উপজেলা কৃষক সমিতির সভাপতি দেবদাস সিংহ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও চাই মহাসড়ক ফোর লেন হোক, তার পাশাপাশি এ প্রকল্পের অধীন মোট ৩৫ হাজার কৃষক বাঁচানোর জন্য আগে খাল ঠিক রাখা হোক। পানিপ্রবাহের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না করেই খাল ভরাট করে মহাসড়কের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে। এতে দেশের প্রাণ কৃষকেরা আজ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি পানিসংকট নিয়ে কৃষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। পানি নাই পানি নাই, কী হবে; এমনটি করছে। ১০ মার্চ উপজেলা সদরে আমরা পরামর্শ সভা করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করব।’
বিএডিসির আশুগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরাইল উপজেলার জন্য ৫৫০ কিউসেক পানির প্রয়োজন। কিন্তু খাল ভরাট হয়ে যাওয়াতে সেখানে শুধু পানি দেওয়া যাচ্ছে ১৫০ কিউসেক। ফলে সর্বত্র পানি পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। বিএডিসির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর শুরুতে পুরো এলাকায় পানি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মহাসড়কের সম্প্রসারণ কাজের ফলে দিন দিন খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে পানিপ্রবাহও কমে গেছে। আমাদের হাতে কোনো বরাদ্দও নেই, যা দিয়ে খাল সংরক্ষণ করা যাবে।’
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবুজ প্রকল্পের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার জন্য সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পের মধ্যে ৬ থেকে ৮ ফুট প্রশস্ত ড্রেন নির্মাণের কথা রয়েছে। কিন্তু এখন দুটি কাজ একসঙ্গে করা যাচ্ছে না। আগামী জুন মাসে সড়কের কাজ শেষে ড্রেন করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া পানিপ্রবাহ কম হওয়াতে আমরা কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বণ্টন করে এলাকাভিত্তিক পানি সরবরাহ করা হবে। কিন্তু কৃষকদের মধ্যে অন্তঃকলহ থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এখন বৃষ্টিই ভরসা। বৃষ্টি হলে সবুজের পানির ওপর চাপ কমবে।’