জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তিনি। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। প্রত্যন্ত এলাকায় বাড়ি। অনেক কষ্টে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ক্লাস করেছেন। ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাস করেছেন আরও ছয় বছর আগে। বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে পড়াশোনা করার পর সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছেন। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় সরকারি চাকরি কপালে জোটেনি তাঁর।
দীর্ঘদিন চেষ্টা করে চাকরি না পাওয়ায় ভীষণ অর্থকষ্টে দিন কাটছে তাঁর। এ পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে সরকারি চাকরির দাবিতে চার দিন ধরে বগুড়ায় আমরণ অনশন করছেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ওই ছাত্রের নাম এস এম বাহারউদ্দিন। তাঁর বাড়ি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার হুয়াকুয়া গ্রামে।
শুক্রবার সকাল থেকে বগুড়া প্রেসক্লাব চত্বরে চতুর্থ দিনের মতো অনশন করছিলেন এস এম বাহারউদ্দিন। শুক্রবার প্রেসক্লাব চত্বরেই তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। এ সময় তিনি সরকারি চাকরির জন্য তাঁর অধ্যবসায় ও চেষ্টার কথা তুলে ধরেন।
এ বিষয়ে এস এম বাহারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শত বাধা পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। সরকারি চাকরির জন্য নানা দপ্তরে আবেদন করেছেন এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। কোনো কোনো সময় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছেন। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় ভাগ্যে চাকরি জোটেনি। গত ২০ ডিসেম্বর সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। তবে কয়েকটি সরকারি কার্যালয়ে আগেই চাকরির জন্য আবেদন করা আছে। করোনার কারণে ওই সব কার্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে না। এখন তিনি হতাশায় ও আর্থিক কষ্টে ভুগছেন। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে বাধ্য হয়ে সরকারি চাকরির জন্য তিনি আমরণ অনশনে নেমেছেন।
সাত ভাইবোনের সঙ্গে শৈশব থেকে চরম দারিদ্র্য আর অভাব–অনটনের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন তিনি। তবে আলোহীন চোখে স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এস এম বাহারউদ্দিনের বাবার নাম হাফিজ উদ্দিন ব্যাপারী। সাত শতক জমির ওপর বসতভিটাটুকুই সম্বল তাঁর বাবার। সাত ভাইবোনের সঙ্গে শৈশব থেকে চরম দারিদ্র্য আর অভাব–অনটনের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন তিনি। তবে আলোহীন চোখে স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। আর্থিক সমস্যার কারণে তাঁর বাবা তাঁকে শৈশবে সন্দাবাড়ি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু বাহারউদ্দিন আট বছর বয়সে নিজের চেষ্টায় বগুড়া জিলা স্কুলে ভর্তি হন।
প্রতিদিন সাদাছড়ি হাতে দীর্ঘপথ হেঁটে, ভ্যানগাড়িতে চড়ে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বগুড়া জিলা স্কুলে যাতায়াত করতেন এস এম বাহারউদ্দিন। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় ভালো ফলাফল করতে পারবেন না, এমন অজুহাতে জিলা স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে রাখতে চাননি। তাতে দমেও যাননি কিশোর এস এম বাহারউদ্দিন। নিজের চেষ্টায় ভর্তি হন গাইবান্ধা ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে গাবতলী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে।
এস এম বাহারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। একটি সরকারি চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তা পাননি। এখন খাদ্য অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক, পরিসংখ্যান ব্যুরোতে জুনিয়র পরিসংখ্যানবিদ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকসহ ১৭টি দপ্তরে আবেদন করেছেন। যেসব পদে আবেদন করা আছে, সেগুলো হাতছাড়া হলে সরকারি চাকরির স্বপ্ন তাঁর অধরাই থেকে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জন না করে রাস্তায় ভিক্ষা করতে পারতাম। তাতে দিনে এক-দুই হাজার টাকা রোজগার হতো। নিজের চলাফেরা করতেও হাত খরচের টাকা লাগে, কিন্তু সেই সামর্থ্যও নেই।এস এম বাহারউদ্দিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র
এস এম বাহারউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জন না করে রাস্তায় ভিক্ষা করতে পারতাম। তাতে দিনে এক-দুই হাজার টাকা রোজগার হতো। নিজের চলাফেরা করতেও হাত খরচের টাকা লাগে, কিন্তু সেই সামর্থ্যও নেই। বৃদ্ধ বাবার বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই। মায়ের বয়স ৭৮ বছর। এখন তাঁদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। উপার্জন না থাকায় বিয়েও করতে পারছি না।’
এস এম বাহারউদ্দিন বলেন, ‘যত দিন সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা না পাব, তত দিন আমরণ অনশন চালিয়ে যাব। চাকরির বয়স শেষ। এখন আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। সরকার হয় চাকরি দেবে, তা না হয়ে অনশন করে আত্মাহুতি দেব।’