ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পানের’ ক্ষয়ক্ষতি দেখতে খুলনার কয়রায় গিয়েছিলাম। গত ২৭ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। এখানে গত চার বছর খাদ্যনিরাপত্তা কার্যক্রমবিষয়ক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছিলাম আমরা। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর আসছিল। মনে হলো স্বচক্ষে দেখা দরকার।
২৭ মে কয়রা উপজেলা সদরে পৌঁছেই আম্পানের তাণ্ডব বোঝা গেল। যদিও তখন ভাটা, অর্থাৎ সাগর থেকে আসা জোয়ারের পানি নেমে যাচ্ছে। কিন্তু উপজেলা শহরের সমস্ত দোকানপাট তখনো পানির নিচে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের সামনের মাঠটি মনে হচ্ছিল কোনো সুসজ্জিত দিঘি! চারদিকে শুধু পানি আর পানি থই থই করছে। সরকারি কর্মকর্তারা অফিস করছেন নৌকায় চেপে! উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে সাড়ে তিনটা ইউনিয়ন পানির নিচে তলিয়ে গেছে! কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি ও দক্ষিণ বেদকাশি এবং মহারাজপুর ইউনিয়নের অর্ধেক পানির নিচে। এগুলো কয়রার সর্বদক্ষিণের ইউনিয়ন।
উপজেলা সদরের মাঝখানের একটা দোকানের সামনে থেকে নৌকা ভাড়া করে কয়রা সদর ও উত্তর বেদকাশির খানিকটা দেখতে পেলাম। সেখানেও যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি। আমাদের নৌকা যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা কোনো নদী কিংবা খাল নয়, বরং মানুষের উঠান, রাস্তাঘাট, সবজিবাগান, ধানখেত কিংবা চিংড়ির ঘের। সব এখন পানির নিচে। কোথাও একটা পরিবারও দেখা গেল না, যাদের ঘরে পানি ওঠেনি। প্রায় প্রতিটা ঘরের অর্ধেক পানির নিচে। কোনো কোনো ঘরের চালা অব্দি পানি। যে ঘরটি মাটি দিয়ে তৈরি, সেটি ভেঙে পানির সঙ্গে মিশে গেছে। দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে বাকি ঘরগুলো! টয়লেট পানিতে ভাসছে। টিউবওয়েল, পানি বিশুদ্ধ করার যন্ত্র, খাওয়ার পানির পাত্রসহ যা ঘরে ছিল, সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। থই থই পানির মধ্যেও চারদিকে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। আম্পানের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ফলে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার গরু-ছাগল ও অন্যান্য গবাদিপশু সরিয়ে নিতে পেরেছিল। বাকি সব মরে ভেসে আছে। কোথাও জীবন্ত গবাদি পশুপাখি চোখে পড়েনি।
খুলনা জেলা পরিষদ কার্যালয়ের হিসাবে কয়রায় আট হাজার বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, আর ১৫ হাজার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৫ হাজার ২০০ ছাগল এবং ১ হাজার ৩৪টি ভেড়া মারা গেছে।
কয়রার এসব ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে। দু-চারটা পরিবারে শুধু বয়স্করা বাচ্চাদের সরিয়ে দিয়ে নিজেরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন সেখানে। ঘরের ভেতর উঁচু করে মাচা বেঁধে থাকছেন তাঁরা। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটা যাতে না হারান, তার শেষ লড়াই। কেউ বেড়িবাঁধের অবশিষ্ট অংশে, কেউ ডুবে না যাওয়া রাস্তার অংশবিশেষে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে উপজেলায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বড় একটা অংশই পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থানান্তরিত। এখান থেকে অভিবাসিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়াই যেন দুর্যোগপ্রবণ এই উপজেলার মানুষের নিয়তি।
উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় কয়রার কয়েক হাজার পরিবার ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি লালন-পালনের সুযোগ পেয়েছিল। কেউ ছোটখাটো ব্যবসা, কেউবা সবজিখেত, মুদিদোকান ইত্যাদি শুরু করেছিলেন। আর কিছুদিন পর তাঁরা অতিদরিদ্র থেকে উঠে আসতে পারতেন। আমাদের হিসাবমতে, আর কারোরই মূলধন অবশিষ্ট নেই। আবার কয়েক দশকের জন্য এই মানুষগুলো দারিদ্র্যের মধ্যে ঢুকে গেলেন!
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ এই এলাকার প্রায় সব শেষ করে দিয়েছিল। তার আগে ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। দুটো ঝড়েই বেড়িবাঁধের বড় একটা অংশ ধসে সমুদ্রের লোনাপানিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। গত ১০ বছরে এ মানুষগুলো একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠছিল কয়রা। আম্পান তাঁদের সব কেড়ে নিল। ২০০৯ সালের আইলায় যে লোনাপানি ঢুকেছিল, সেই পানি ঢোকার মধ্য দিয়ে এই এলাকার জীবিকা কৃষিনির্ভর থেকে চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকে যায়। ফলে দরিদ্র হয়ে পড়ে আরও দরিদ্র। গত ১০ বছরে মানুষ একটু একটু করে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন। জমিতে আবার ধান, তরমুজ, সবজি চাষ হচ্ছিল! লবণ শুষে নিয়ে আবার কৃষির দিকে মুখ ফেরাচ্ছিলেন ভূমিদেবতা। এবার ছিল বাম্পার ফলন। কিন্তু আম্পানে সব শেষ। নিঃস্ব হয়ে গেল হাজার হাজার পরিবার।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আম্পানে কয়রার বেড়িবাঁধ অন্তত ১৮ স্থানে ভেঙেছে। বলা দরকার যে এ এলাকার বাঁধগুলো ৬০ বছরের পুরোনো। ২০ বছর আগেই এগুলোর মেয়াদ পেরিয়েছে। পাকিস্তান আমলে সেচের স্বার্থে এগুলো তৈরি হয়েছিল। পরে শুধু সংস্কার ও লম্বালম্বিভাবে বাঁধগুলোর আয়তন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার সবটাই অবৈজ্ঞানিকভাবে এবং বাঁধের সামনে বনাঞ্চল সৃষ্টি না করেই। বাঁধের সামনে বনের পাহারা না থাকলে তা সহজেই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়। এর আগের সব ঝড়ে তা দেখা গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, যানবাহন চলাচল, বাঁধ কেটে চিংড়ির ঘেরে লোনাপানি ঢোকানো এবং সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ভাঙন ত্বরান্বিত হয়েছে। আম্পানের তিন দিন পর, অর্থাৎ ঈদের দুই দিন আগে স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য নেমে গেলেন। তাঁরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কাজটা শুরুও করেছিলেন। হাতে হাত ধরে মাটির ঢেলা দিয়ে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেন তাঁরা! এক ফোঁটা কম পানি ঢোকা মানে তাঁদের জন্য আনন্দের। মাইলের পর মাইল নৌকায় ঘুরে একচিলতে খালি জায়গাও দেখা যায়নি। নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘স্যার, উপকূলের মাইনষ্যের কোনো দল নাই! তাগো কেউ নাই, স্যার!’
দুর্গত মানুষদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দরকার। সরকার ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে জরুরি ভিত্তিতে দুর্গত মানুষের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি সামগ্রী বিতরণ করা জরুরি। এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন কর্মসূচি, যাতে জনগণ এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। বিকল্প জীবিকার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আর বিচ্ছিন্নভাবে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক, যদি বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা না করা হয়, বেড়িবাঁধ নির্মাণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তাহলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। কয়রাবাসীর দুঃখও ঘুচবে না।
রাজু নুরুল: ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে কর্মরত