অন্যের জমিতে কামলা খেটে ছেলে-মেয়েকে বড় করেছেন জমির উদ্দিন (৮৫) ও রশিদা বেগম (৭০) দম্পতি। তিন ছেলে-তিন মেয়ের মুখে খাবার জোটাতে কখনো কখনো নিজেদের পেটে দানা পড়েনি এই বাবা-মায়ের। এর মধ্য দিয়েই একে একে সবাইকে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। সবাই যাঁর যাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেরা আলাদা থাকলেও বাবার ভিটেতেই ঘর তুলে থাকেন। পাঁচ বছর ধরে জমির উদ্দিনের শরীর আর পারছে না। এক পা অনেকটা অবশ হয়ে আছে। তাই ছেলেদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাঁরা।
এক এক ছেলের ঘরে পালা করে খাওয়াদাওয়া চলে বৃদ্ধ দম্পতির। কিন্তু খাবারের সঙ্গে জোটে অনেক লাঞ্ছনাও। তারপরও মুখ বুজে সহ্য করে নেন সব। কাকে কী বলবেন। নিজেদেরই তো সন্তান। বছরখানেক আগে ভিটেবাড়িটি নিজেদের নামে লিখিয়ে নেন ছেলেরা। এরপর থেকে ছেলে ও ছেলে বউদের আচরণ পাল্টে যেতে থাকে। তাঁদের অবজ্ঞা আর অবহেলায় এই দম্পতির মনে অভিমানের পাহাড় জমতে থাকে। একপর্যায়ে গতকাল রোববার বাড়ি ছেড়ে পাশের একটি স্কুলের পরিত্যক্ত কক্ষে গিয়ে ওঠেন এই দম্পতি। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে বাড়িতে রেখে আসে।
নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ঘটে এ ঘটনা। বাবা-মায়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও ভরণপোষণ না দেওয়ায় পুলিশ ওই তিন ছেলেকে আটক করে। পরে বাবা-মায়ের ভরণপোষণ ও ভালো আচরণ করার শর্তে মুচলেকায় ছাড়া পান তাঁরা।
জমির উদ্দিন ও রশিদা বেগম দম্পতি বলেন, মাঝে তাঁদের প্রতি সদয় হয়ে উঠেছিলেন তিন ছেলে ও তাঁদের স্ত্রীরা। ঠিকমতো খাবার দেওয়া, গোসল করানোসহ যত্ন–আত্তির কমতি ছিল না। একপর্যায়ে তাঁর ৩ শতক জায়গা লিখে নেন তিন সন্তান। সেটা বছরখানেক আগের ঘটনা। ভিটেবাড়ি লিখে নেওয়ার পর থেকে সন্তানেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না। ছেলের বউয়েরা ঠিকমতো খাবার দেন না। খারাপ আচরণ করছেন। তাঁদের অমানবিক আচরণের কারণে ভিটে ছেড়ে পাশের একটি বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা।
আজ সোমবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, মেজ ছেলের ঘরের বারান্দায় বসে আছেন তাঁরা। তিন ছেলের ঘর আধা পাকা। আর বাবা-মায়ের থাকার ছাপরা ঘরটি জরাজীর্ণ। কয়েক মাস পর আজ দুপুরের খাবারটি আন্তরিকতার সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল বলে জানালেন রশিদা বেগম।
বড় ছেলে জালাল উদ্দিন দাবি করেন, বাবা-মায়ের থাকার ঘরটি মেরামতের দরকার হওয়ায় কয়েক দিনের জন্য তাঁদের মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলা হয়েছিল। সেখানে না গিয়ে বাড়ির পাশের একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। বাবা-মায়ের প্রতি অবহেলার অভিযোগটি সত্য নয়।
জালালের স্ত্রী বুলবুলি খাতুন বলেন, ‘আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। ভবিষ্যতে এমনটি আর ঘটবে না।'
গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোজাহারুল ইসলাম বাবা-মাকে ভরণপোষণ না দেওয়া এবং খারাপ আচরণের কারণে তিন ছেলে জালাল উদ্দিন (৪৫), আলাল উদ্দিন (৪২) ও রসুল উদ্দিনকে (৩৮) আটক করা হয়েছিল। তাঁরা অনুতপ্ত হওয়ায় মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই বৃদ্ধ দম্পতির জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন বলেন, সন্তান যদি বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব না নেন, তাহলে প্রতিকার পেতে ওই বাবা-মা আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। আইনের ব্যত্যয় ঘটলে সন্তানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও থাকছে। আইনে এই অপরাধে ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাস জেলের বিধান রয়েছে।