খাসজমি পেয়েছেন কাউখালীর উজিয়ালখান গ্রামের দোতলা বাড়ির মালিক তিতাস মণ্ডল
খাসজমি পেয়েছেন কাউখালীর উজিয়ালখান গ্রামের দোতলা বাড়ির মালিক তিতাস মণ্ডল

পিরোজপুরের কাউখালী

সচ্ছলেরা পেলেন খাসজমি

খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়া ১৩৭ জনের মধ্যে ৫৩ জনই ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও সচ্ছল।

দরিদ্র ও ভূমিহীনদের বদলে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলায় সচ্ছল ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা, প্রবাসী, সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা খাসজমি বন্দোবস্ত পেয়েছেন। তালিকায় রয়েছেন দোতলা পাকা বাড়ির মালিকও। কিন্তু অন্যের জমিতে ছাপরা তুলে বাস করেন, এমন হতদরিদ্র নারী আবেদন করেও সরকারি জমি পাননি।

কাউখালীতে খাসজমি বন্দোবস্ত পাওয়া ১৩৭ জনের নামের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী ২০ জন, সচ্ছল ব্যক্তি ২৫ জন, প্রবাসী তিনজন, চাকরিজীবী ও তাঁদের স্ত্রী ৫ জনসহ মোট ৫৩ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাঁরা ভূমিহীন নন, বরং অনেকেই এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জমি ও সম্পদের মালিক বলে পরিচিত। ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসক খাসজমি বন্দোবস্তের তালিকাটি অনুমোদন দিয়েছেন। বিষয়টি সম্প্রতি জানাজানি হয়।

জানতে চাইলে পিরোজপুরে সদ্য যোগ দেওয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনো অভিযোগ পাইনি। তবে আশ্বস্ত করছি, যদি খাসজমি নীতিমালা অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুযায়ী, খাসজমি বন্দোবস্তের বেলায় অগ্রাধিকার পাবে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, সব জমি নদীতে ভেঙে গেছে এমন পরিবার, বিধবা ও স্বামী নেই, এমন নারী ও তাঁর পরিবার, কৃষিজমিহীন ও বসতভিটাহীন পরিবার, ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ভূমিহীন হয়ে পড়া পরিবার এবং ১০ শতাংশ বসতবাড়ি আছে, কিন্তু কৃষিজমি নেই, এমন কৃষিনির্ভর পরিবার।

এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তি খাসজমি বরাদ্দ পাওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু সেই নিয়ম লঙ্ঘন করে এক পরিবারের ৫ সদস্য ১০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ পেয়েছেন।

কাউখালী উপজেলা সদরের উজিয়ালখান গ্রামের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার তিতাস মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী সরকারি কলেজের প্রভাষক সম্পা সাহা ওই গ্রামেই ১০ শতাংশ খাসজমি বন্দোবস্ত পেয়েছেন। যার দাম প্রায় ১০ লাখ টাকা। ওই দম্পতির কাউখালী শহরে রয়েছে দোতলা পাকা বাড়ি। জানতে চাইলে তিতাস মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, খাসজমির জন্য সাত-আট বছর আগে আবেদন করেছিলেন। তবে ওই জমি বন্দোবস্ত পেয়েছেন কি না, তা তিনি জানেন না।

খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়ার তালিকা সম্প্রতি প্রকাশের পর স্থানীয় দরিদ্র ও ভূমিহীনদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে গত ১৬ জানুয়ারি উপজেলার চিরাপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারেক হাওলাদার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, উপজেলা সদর ও আশপাশে মূল্যবান খাসজমি এলাকার প্রকৃত ভূমিহীনদের বরাদ্দ না দিয়ে সরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী, ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। আর ওই সব জমি উপজেলা সদরের আশপাশে হওয়ায় এর বাজারমূল্যও বেশি। টাকার বিনিময়ে খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটিকে প্রভাবিত করে নিজেদের নামে জমি বরাদ্দ নিয়েছেন প্রভাবশালীরা।

খাসজমির আবেদন করেও পাননি কাউখালীর গন্ধর্ব গ্রামের ভূমিহীন পুষ্প ব্যাপারী

জানতে চাইলে কাউখালী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জান্নাত আরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সব খাসজমি আমার যোগদানের আগে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। তাই বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এমন অনিয়মের বিষয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা একটি অভিযোগ দিয়েছেন বলে শুনেছি।’

কাউখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটির উপদেষ্টা আবু সাঈদ বলেন, ‘২০১৯ সালে আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ভূমিহীন ছাড়া কাউকে খাসজমি দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দখলে থাকা খাসজমি উদ্ধার করে আমরা ভূমিহীনদের সেখানে পাকা ঘর করে দিচ্ছি।’

উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাউখালী উপজেলা কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটির কাছে ১৩৭টি আবেদন জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই করে উপজেলা কমিটির সুপারিশে জেলা কৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত কমিটি সব আবেদনের চূড়ান্ত অনুমোদন করে। বিধি অনুযায়ী, খাসজমি স্বামী ও স্ত্রীর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে বিধবাদের বেলায় একক নামে জমি বরাদ্দ হয়েছে। বেশির ভাগ পরিবারকে ১০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কয়েকজনকে ১২ ও ১৫ শতাংশ করে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তবে উপজেলার শিয়ালকাঠি গ্রামের আশ্রাফ আলীর মেয়ে সামসুন্নাহার ওরফে হাসি উজিয়ালখান গ্রামে ৫০ শতাংশ খাসজমি বন্দোবস্ত পান। স্থানীয়রা জানান, সামসুন্নাহারের নাম ব্যবহার করে খাসজমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন তাঁর স্বামী সয়না রঘুনাথপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। নজরুল তহশিলদার হওয়ায় তদবির করে ৫০ শতাংশ খাসজমি নিজের স্ত্রীর নামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন।

সামসুন্নাহার এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে সামসুন্নাহার তাঁর স্ত্রী, এ কথা অস্বীকার করেছেন নজরুল ইসলাম। তবে নজরুল ও সামসুন্নাহার স্বামী-স্ত্রী, এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন নজরুলের প্রতিবেশী ও শিয়ালকা‌ঠি ইউনিয়‌নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বেলা‌য়েত হো‌সেন। উজিয়ালখান গ্রামে ৫০ শতাংশ জমির দাম কম করে হলেও ৫০ লাখ টাকা হবে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

তালিকা অনুযায়ী, সৌদিপ্রবাসী আবদুল মান্নান হাওলাদার ও তাঁর স্ত্রী লাইলী বেগম চিরাপাড়া পারসাতুরিয়া মৌজায় ১০ শতাংশ জমি বরাদ্দ পেয়েছেন। আরেক সৌদিপ্রবাসী উত্তর নিলতী গ্রামের সোয়েবুর রহমানও ১০ শতাংশ খাসজমি পেয়েছেন। চিরাপাড়া গ্রামের জিয়াদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী রিপা আক্তার ১০ শতাংশ জমি পেয়েছেন। জিয়াদুল ইসলাম অন্তত ১৫ বিঘা জমির মালিক বলে তাঁর আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিরাপাড়া পারসাতুরিয়া মৌজায় এক শতাংশ জমির দাম এক লাখ টাকা।

অথচ উপজেলার চিরাপাড়া গ্রামের বিধবা ছাহেরা বেগম (৫০) ভূমিহীন। তিন সন্তান নিয়ে থাকেন একই গ্রামের মহিউদ্দিনের একটি পরিত্যক্ত ঘরে। ছাহেরা বেগমের বড় ছেলে ইমন বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী, ছোট ছেলে লিমন এখনো কিশোর বয়সী। মেয়ে ফাতেমার বয়স ১০। ছাহেরা বেগম জানান, কয়েক বছর আগে খাসজমির জন্য ভূমি কার্যালয়ে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো জমি বন্দোবস্ত পাননি। সরেজমিনে দেখা গেছে, ছাহেরার কাঠ ও টিনের তৈরি ঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন মেরামত না করায় ঘরটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

খাসজমির আবেদন করেও পাননি কাউখালীর গন্ধর্ব গ্রামের ভূমিহীন পুষ্প ব্যাপারী। ভাইদের জমিতে জরাজীর্ণ একটি ঘরে তিনি কোনোমতে বাস করছেন।

খাসজমির আবেদন করেও পাননি কাউখালীর চিরাপাড়ার বিধবা ছাহেরা বেগম

সচ্ছলদের জমি বরাদ্দ দেওয়ার নজির আরও আছে। উপজেলা সদরের বেকারির মালিক, ব্যবসায়ী আবদুর রহিম খন্দকারের স্ত্রী রানু বেগমের নামে উপজেলার সুবিদপুর এলাকায় ১০ শতাংশ খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। রহিম খন্দকার তাঁর স্ত্রীর নামে জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সুবিদপুর এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির দাম ৫০ হাজার টাকা বলে জানা গেছে।

উপজেলা সদরের দক্ষিণ বাজারের ব্যবসায়ী শাহ আলমের ছেলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বশির উদ্দিনের নামে চিরাপাড়া পারসাতুরিয়ায় ১০ শতাংশ খাসজমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বশির উদ্দিনের বাবার উপজেলা সদরে দোতলা পাকা ভবন রয়েছে। তবে বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমার নিজের নামে কোনো জমি নেই। তাই খাসজমির আবেদন করেছি।’

এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তি খাসজমি বরাদ্দ পাওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু উপজেলার চিরাপাড়া গ্রামের মৃত বশির উদ্দিনের স্ত্রী জাহানারা বেগম, ছেলে মামুন মোড়ল, জাকির হোসেন মোড়ল, খোকন মোড়ল ও মেয়ে তারতিলা খানম ১০ শতাংশ করে খাসজমি পেয়েছেন।

বাংলাদেশ কৃষক খেতমজুর সমিতি পিরোজপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কাউখালী উপজেলা শাখার সদস্য নিমাই মণ্ডল বলেন, ‘ভূমি কার্যালয়ের একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার কারণে প্রকৃত ভূমিহীন ব্যক্তিরা খাসজমি বন্দোবস্ত পাচ্ছেন না। আমরা বিভিন্ন সময়ে নদীভাঙনের কারণে ভূমিহীনদের জন্য খাসজমির আবেদন করলেও তাঁরা বরাদ্দ পাননি। ধনী ব্যক্তিদের নামে খাসজমি বন্দোবস্ত দেওয়া খুবই দুঃখজনক।’