ডাল-তেলের ব্যাগটা পাশে রেখে মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছিলেন আজিমুন্নেসা। তপ্ত দুপুরের কড়া রোদে লম্বা লাইনের ধকলে হাঁটার শক্তি নেই তাঁর। ষাটোর্ধ্ব আজিমুন্নেসা যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে কয়েক হাত দূরে খুলনা নগরের শশীভূষণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। একেবারে ফটকের ওপর দাঁড়ানো ট্রাক ঘিরে কয়েক শ নারী-পুরুষের লম্বা লাইন। ট্রাকটিতে সাশ্রয়ী মূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি চলছে।
আজিমুন্নেসা রোববার সকাল ৯টায় সেখানে এসেছেন। পণ্য দেওয়া শুরু হয়েছে দুপুর ১২টায়। এরপর ঘণ্টা দেড়েক পর হাতে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত পণ্য। আজিমুন্নেসা জানালেন, রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ক্লান্ত। পাঁচজন পুরুষ তারপর সাতজন নারী, আবার পুরুষ এভাবে লাইন এগোচ্ছে। তবে কম দামে পণ্য পেয়েও খুব বেশি খুশি হতে পারেননি আজিমুন্নেসা। তিনি বললেন, ‘এত কষ্ট কইরে যেসব মাল পালাম তাতে ভালো হুয়েছে; তবে সঙ্গে কডা চাল দিলি খাইয়ে বাঁচতাম।’
মনিকা রানী সাড়ে ৯টায় এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। অবশ্য তাঁর আগেই লাইনটা লম্বা হয়ে গিয়েছিল। পরে সেটা আরও বেড়েছে। বেলা দেড়টা দিকে মনিকা বলেন, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। সকালের দিকে দিলে ভালো হতো। এই ভরদুপুরে লম্বা সময় দাঁড়ানো কষ্টের।
লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে নগরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়ার সপু মাতব্বর ও সোহরাব হোসেন নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করছিলেন, সেখানেও চালের প্রসঙ্গ উঠে এল। তাঁদের ভাষ্য, টিসিবির এই উদ্যোগ ভালো। তবে আরেকটু পরিমাণ বাড়ালে ভালো হতো। সঙ্গে চাল দিলে ভালো হতো।
খোলাবাজারে (ওএমএস) তো চাল দিচ্ছে, এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবির কার্ড পাওয়া ওই দুই ব্যক্তি জানালেন, দিচ্ছে, তবে এর জন্যও সকালে লাইন দিতে হয়। আবার পাওয়া যায় না। সবাই নিতে পারবে না। তাঁরা দিনমজুর। চালের টাকা বাঁচাতে গেলে কাজ মার যাবে। তখন আবার বাজারের টাকা কোথায় মিলবে? কমিশনারদের বাড়িতে গিয়ে তাঁরা কার্ড নিয়েছেন। টিসিবির মাধ্যমে এই কার্ডের সঙ্গে চাল দিলে ভালো হতো। গরিব মানুষের জন্য চালটাই প্রধান।
বাজারে সব জিনিসের দামে আগুন। একটা কার্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে সঙ্গে যদি চাল দিত, অনেক উপকার হতো।লাইজু বেগম, টিসিবির পণ্য ক্রেতা
বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোববার থেকে প্রথম ধাপে স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি শুরু করছে টিসিবি। আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে খুলনা জেলায় এবার ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য পাচ্ছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৭১৬টি পরিবার। এর মধ্যে খুলনা নগরে আছে ৮৫ হাজার ৮০২ পরিবার। বাকি ১ লাখ ৫ হাজার ৯১৪ পরিবার জেলার ৯টি উপজেলায়। দরিদ্র পরিবারগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।
রোববার নগরের ১, ২, ৩ এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ১৬টি পয়েন্টে ১৬টি ট্রাকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। কার্ডধারী প্রত্যেকে ৫৫ টাকা দরে ২ কেজি চিনি, ৬৫ টাকা কেজিদরে ২ কেজি মসুর ডাল ও প্রতি লিটার ১১০ টাকা দরে ২ লিটার সয়াবিন তেল পাচ্ছেন। সোমবার ৫, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে পণ্য বিক্রি করা হবে।
রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে নগরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দেয়ানা এলাকায় সূর্যের হাসি ক্লিনিক মোড়ের পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাক ঘিরে কয়েক শ মানুষের হুড়োহুড়ি-ধাক্কাধাক্কি। অনেকের হাতেই ছাতা। আবার হাতে থাকা ব্যাগ দিয়ে কেউ কেউ বাতাস খাচ্ছেন। ভিড় কমার অপেক্ষায় কিছুটা দূরে সুবিধাজনক স্থানে বসে আছেন অনেকে। নিজের কার্ড নিজে এনেছেন, কেউ বাবার কার্ড, কেউবা মায়ের কার্ড নিয়ে এসেছেন। টিসিবির লোকজন বারবার লাইন সোজা করছেন, তবে কিছুক্ষণ পরপর আবার গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে হুড়োহুড়ি লাগছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মো. কাশেম নামের এক কার্ডধারী বলেন, একটা টেবিল। লাইন টানছে না। মাইকের ব্যবস্থা নেই। টাকা আর কার্ড জমা নিয়ে ক্রমিক নম্বর অনুসারে মাইকে নাম ডেকে পণ্য দিলে কোনো ঝামেলা হয় না। মানুষ শঙ্কায় আছে, শেষ পর্যন্ত সবাই পাবে কি না।
এদিকে অনেকে নির্ধারিত দিন না জেনেই এসে ফিরে যাচ্ছেন। এ রকমই একজন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের রাহেলা বেগম। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে মিথিলাকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেন, অনেক দৌড়াদৌড়ি করে কার্ড পেয়েছেন। ভয়ে থাকতে হয়, যদি আবার মিস হয়ে যায়। এ জন্য তিনি এসেছেন। এসে জানলেন, আজ তাঁদের ওয়ার্ডে দেবে না।
টিসিবির পণ্য পরিবেশক কামাল চৌধুরী বলেন, একই সময়ে সবাই আসছেন। সামলানো যাচ্ছে না। কথাও শুনছেন না। কার্ড থাকলে সবাই পণ্য পাবেন, এটা বারবার বোঝানো হচ্ছে।
ট্রাক থেকে একটু দূরে ফাঁকা জায়গায় ব্যাগ হাতে একা বসেছিলেন লাইজু বেগম। তিনি বলছিলেন, বাজারে সব জিনিসের দামে আগুন। একটা কার্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তবে সঙ্গে যদি চাল দিত, অনেক উপকার হতো।