সখীপুরে ৩৫ হাজার একর জমির খাজনা আদায় বন্ধ ২৩ বছর

টাঙ্গাইল জেলার মানচিত্র
টাঙ্গাইল জেলার মানচিত্র

প্রায় দুই যুগ ধরে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার ১৪টি মৌজার ৩৫ হাজার একর জমির খাজনা আদায় বন্ধ আছে। মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতায় উপজেলার কমপক্ষে এক লাখ মানুষ জমির খাজনা দিতে পারছেন না। এতে নামজারিও বন্ধ আছে। আর জমির নামজারি না হওয়ায় বৈধভাবে জমি কেনাবেচা কিংবা ব্যাংকঋণ নিতে করতে পারছেন না মালিকেরা।

এ অবস্থায় খাজনা নেওয়ার দাবিতে আবারও আন্দোলনের কথা ভাবছে সখীপুরে ভূমিমালিকদের সংগঠন ‘ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি’। খাজনা দেওয়ার দাবিতে ভূমিমালিকদের নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে ওই কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি নিজ এলাকায় হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার এই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনার কারণে দুই বছর পর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এই সভা হয়। কমিটির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ‘সমস্যার সমাধানকল্পে আমাদের কমিটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি সমাধানে কাজ করছে। করোনার কারণে কাজটি থেমে আছে। আজ (২ নভেম্বর) আমরা সভা করেছি। আগামী সপ্তাহে আবার আরেকটি সভা ডাকা হয়েছে। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমেই আমরা সমাধানে অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। প্রয়োজনে আবারও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। যে পর্যন্ত খাজনা নেওয়া না হবে, সে পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না।’

সখীপুরে সংশ্লিষ্ট ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ ১৪টি মৌজায় ১৯৭৬-৮৫ সালে দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে আরএস (রিভিশন সার্ভে) জরিপ সম্পন্ন হয়। এরপর ভূমিমালিকদের বরাবর নকশা ও পরচা দেওয়া হয়। ১৪ মৌজার মধ্যে প্রথমে ৮টি মৌজার ভলিউম স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ে আসে এবং খাজনা আদায়ের নির্দেশও আসে। ওই সময় (১৯৯৮ সাল) বন বিভাগ তাদের কিছু জমি ওই রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে দাবি করে আপত্তি দিলে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় খাজনা (ভূমি কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর পার হলেও আর খাজনা নেওয়া হয়নি। ১৪ মৌজার খাজনা আদায় না হওয়ায় সরকার প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

উপজেলার এ ১৪টি মৌজা হচ্ছে গড়গোবিন্দপুর, সখীপুর, প্রতিমাবংকী, লাংগুলিয়া, বেড়বাড়ি, রতনপুর, হাতীবান্ধা, হতেয়া, বাজাইল, কালমেঘা দেওয়ানপুর, কালমেঘা আতিয়া, কালমেঘা তালেপাবাদ, চতলবাইদ ও বহুরিয়া চতলবাইদ।

প্রতিমা বংকী গ্রামের কাশেম সিকদার বলেন, ‘১০০ থেকে ১৫০ বছর ধরে ভোগদখল করলেও খাজনা না নেওয়ায় আমরা জমি চাষাবাদ করতে পারলেও বৈধভাবে বিক্রি করতে ও ব্যাংকঋণ তুলতে পারছি না। আমরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে আছি।’

গড়গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা ও সখীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আহাম্মদ আলী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমির কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংকঋণও নিয়েছি। এখন ওই জমি বিক্রি করতে ও খাজনা দিতে পারছি না। নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বিক্রি করা যায়। কিন্তু ন্যায্যমূল্য দিয়ে কেউ ওই জমি কিনে নিচ্ছেন না।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি ২০১৭ সালের ২২ মে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা দেয়। এ ধরনের বড় কর্মসূচির খবর পেয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকের আশ্বাস দিলে আন্দোলন থেমে যায়। এর মধ্যেই ওই জেলা প্রশাসক বদলি হয়ে যান। এরপর ওই বছরের ৩১ জুলাই নতুন জেলা প্রশাসক খান নুরুল আমিনের সঙ্গে আন্দোলনকারীরা বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও সখীপুর সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) সদস্যসচিব করে ৯ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এরপর ওই কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করলেও ভূমির জটিলতা নিরসনে তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সূত্র দাবি করে, ভূমিমালিকদের দাবির পক্ষের প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

আন্দোলন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জুলফিকার হায়দার কামাল বলেন, ২ নভেম্বর সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিগগির কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে খাজনা নেওয়ার বিষয়ে আবারও আন্দোলনে নামার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

ওই মৌজাগুলোতে ভবন নির্মাণ করে কার্যালয় গড়া বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) এখন বেকায়দায় পড়েছে। প্রশিকা, ব্র্যাক, গ্রামীণ প্রযুক্তি, ব্যুরো-বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি এনজিওকে প্রতি বছরই বহুতল ভবন সরিয়ে নিতে স্থানীয় ভূমি কার্যালয় নোটিশ দিয়ে যাচ্ছে।

সখীপুর প্রশিকা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. রতন মিয়া বলেন, প্রশিকা ৩২ বছর আগে প্রথমে ১০ শতাংশ ও পরের বছর ৬০ শতাংশ জমি কিনে পাকা ভবন করে কার্যালয় বানিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। দুই বছর আগে কোনো নোটিশ না দিয়ে সীমানাপ্রাচীরের ভেতর পৌর ভূমি কার্যালয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান লিখে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হা-মীম তাবাসসুম প্রভা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা না আসায় আমরা ভূমি উন্নয়ন কর নিতে পারছি না।’

জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ জোয়াহেরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘খাজনা সমস্যা নিয়ে আমি গত ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সুস্পষ্টভাবে আমার বক্তব্য তুলে ধরেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। শিগগির সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।’