সংসার-সন্তান সামলেই পুলিশ ক্যাডারে নুসরাত

মেয়ে নুজাইবাহ রাহাতের সঙ্গে নুসরাত ইয়াছমিন। ছবি: সংগৃহীত
মেয়ে নুজাইবাহ রাহাতের সঙ্গে নুসরাত ইয়াছমিন।  ছবি: সংগৃহীত

স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এরপর একদিকে সংসারের কাজ, অন্যদিকে অসুস্থ শ্বশুর আর দেবরকে সামলানো। হয়ে পড়েন পুরোদস্তুর গৃহিণী। এর বাইরেও ছিল নানা বাধা। কিন্তু এর মধ্যেই একটু সময় পেলে চোখ বুলিয়ে গেছেন বইয়ের পাতায়। সেই সংগ্রাম আর কষ্টের দিনগুলো বৃথা যায়নি। প্রথমবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েই তিনি মনোনীত হয়েছেন পুলিশ ক্যাডারে।

অদম্য এই তরুণীর নাম নুসরাত ইয়াছমিন। ৩৮তম বিসিএসের (পুলিশ) মেধাক্রমে ৮২তম হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করা এই নারী।

নুসরাত ইয়াছমিনের বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফরহাদাবাদে হলেও শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায়। শ্বশুরবাড়িতে সংসারের কাজ একা তাঁকেই সামলাতে হতো। শাশুড়ি মারা গেছেন। শ্বশুর অনেক দিন ধরে অসুস্থ। একমাত্র দেবরও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। যখন বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। এরপর দুই মাস বয়সী বাচ্চাকে আত্মীয়ের বাসায় রেখে যোগ দেন মৌখিক পরীক্ষায়।

সংগ্রাম শব্দটা অবশ্য নুসরাতের কাছে নতুন নয়। উচ্চমাধ্যমিকে পড়েছেন চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরের নগরের এই কলেজে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হতো। কখনো বাসে চড়ে, কখনোবা টেম্পোতে চেপে। এইচএসসি পাস শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভর্তি হলেও সেই সংগ্রাম শেষ হয়নি।

সেই গল্পটা শোনা যাক নুসরাত ইয়াছমিনের মুখ থেকেই। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারের চার ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র আমিই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছি। অন্য তিন ভাইবোনের পড়াশোনা থেমে যায় এসএসসিতেই। অনেকটা পরিবারের চাপাচাপিতেই দ্বিতীয় বর্ষে বিয়ে হয়ে যায়। এরপর আমার ঠিকানা হয় শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায়। সে জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে তেমন ক্লাস করতে পারিনি। স্যারদের সমস্যার কথা বুঝিয়ে কোনোভাবে পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক শেষ করি। একই চাপের কারণে স্নাতকোত্তরও পাস করা হয়নি।’

>৩৮তম বিসিএসের (পুলিশ) মেধাক্রমে ৮২তম হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা নুসরাত।

নুসরাতের পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্নের দৌড়ের শুরু অনেক আগেই, কৈশোরে। স্কুলে পড়ার সময় গার্লস গাইড করতেন। কলেজে ছিলেন বিএনসিসির সক্রিয় সদস্য। নুসরাত বলেন, ‘ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসা সেই ছোটকাল থেকেই। একটু বড় হতেই যখন জানলাম বিসিএস দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ আছে, তারপর থেকে সেই স্বপ্ন ছুঁতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছি। আজকের এই সাফল্যের পেছনে ওই ইউনিফর্মের প্রতি ভালোবাসাটার একটা ভূমিকা আছে।’

কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নে নুসরাত ফিরে গেলেন দুই বছর আগের সেই দিনগুলোতে। বলেন, ‘স্নাতক শেষ করার পর ২০১৭ সালে কুমিল্লা শহরের একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হই। কাজের চাপ থাকলেও প্রতিদিনের জন্য আলাদাভাবে রুটিন করে নিতাম। নিজেকে বলতাম, যতই কাজ থাকুক, এই পড়াটা আজকের মধ্যেই শেষ করতে হবে।’

সাফল্যের পেছনে ব্যাংকার স্বামী রাহাত হোসেনের অবদানের কথা বলতেও ভোলেননি নুসরাত। ‘ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে পড়ে বিসিএস ক্যাডার হবা। তা-ও নারী হয়ে পুলিশ কর্মকর্তা—এমন তির্যক বাক্য আশপাশ থেকে ছুড়ে দিত অনেকেই। কিন্তু স্বামী সাহস জুগিয়ে সব সময় বলেছেন, “তুমি পারবেই।”’ যোগ করেন নুসরাত।

এখন বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার মনোনীত হওয়ার পর নুসরাত চোখ রেখেছেন আরও দুটি স্বপ্নে। অবশ্যই দেশসেবা করতে চান। আর কাজ করতে চান নারীদের নিয়ে। একবুক স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারছেন না যেসব তরুণী, তাঁদের টেনে তুলতে চান। একেবারে নিজের জীবনের গল্পের মতো করে।