বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী ‘নওয়াববাড়ি’ (নওয়াব প্যালেস) শেষ পর্যন্ত ভাঙা পড়ছে। উচ্চ আদালত থেকে রায় পেয়ে নওয়াব প্যালেসের ভেতরে থাকা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর ম্যুরালসহ বেশ কিছু স্থাপনা গতকাল রোববার থেকে ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।
২০১৬ সালের মে মাসে নওয়াব প্যালেসকে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে সাইনবোর্ডও টাঙিয়েছিল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। কিন্তু দীর্ঘদিনেও নওয়াব প্যালেস অধিগ্রহণ কিংবা নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয় সরকার। অন্যদিকে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি পুরাকীর্তি ঘোষণায় সরকারের গেজেট প্রকাশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন মালিকানা দাবিদার বগুড়ার তিন ব্যবসায়ী। তাঁরা নওয়াব পরিবারের উত্তরসূরিদের কাছ থেকে ২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল নওয়াব প্যালেস কবলা দলিল করে নেন। এই তিন ব্যবসায়ী হলেন বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান মিলন, বগুড়ার ব্যবসায়ী ও হাসান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম শাফিকুল হাসান এবং শাহ সুলতান গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল গফুর।
মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে উত্তরসূরিদের কাছ থেকে তাঁরা নওয়াব প্যালেস কেনেন। কিন্তু ক্রয় করা এই বাড়িকে অবৈধভাবে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে গেজেট ঘোষণা করে সরকার। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। গত বছরের ৯ মার্চ আদালত মালিকদের পক্ষে রায় দেন। এ বছরের ১৮ জানুয়ারি আদালত গেজেট বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
নওয়াব প্যালেস ভাঙা হচ্ছে কি না, তা জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা এখন আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি। এটা ভাঙা না ভাঙার ব্যাপারে কাউকে আমরা কৈফিয়ত দেব না। আমাদের কেনা সম্পত্তিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ছবি কেন রাখব আমরা? ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছু কাজ করছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নওয়াব প্যালেসের ফটকে একসময় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল ‘কোনো ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির কোনো রকম ধ্বংস বা অনিষ্ট সাধন করলে, এর কোনো বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ ঘটালে, এর কোনো অংশের ওপর লিখলে বা খোদাই করলে, কোনো চিহ্ন বা দাগ কাটলে, ১৯৬৮ সালের ১৪ নম্বর পুরাকীর্তি আইনের ১৯ ধারার অধীনে তিনি সর্বাধিক এক বছর পর্যন্ত জেল বা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড এখন আর নেই।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুনেছি, আদালত মালিক দাবিদারদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। তবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে এ-সংক্রান্ত কোনো নথি আমাকে পাঠানো হয়নি। খোঁজ নেওয়ার পর বিস্তারিত জানাতে পারব।’
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর স্মৃতিবিজড়িত ‘নওয়াব প্যালেস’ ওয়াক্ফ সম্পত্তি বলেই পরিচিত। এ কারণে তা হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্যক্তিসম্পত্তি দেখিয়ে ‘নওয়াব প্যালেস’ বিক্রির তৎপরতা শুরু হয়। তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বাড়িটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণার কাজ শুরু করে। এর মধ্যেই নওয়াব পরিবারের দুই উত্তরসূরির কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে নওয়াব প্যালেস কিনে নেন শহরের তিন ব্যবসায়ী। বগুড়া সদর সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ে নওয়াবের দুই ছেলে সৈয়দ হামদে আলী ও সৈয়দ হাম্মাদ আলীর কাছ থেকে নওয়াব প্যালেসের ১ একর ৫৫ শতাংশ সম্পত্তি ওই তিন জনের নামে দলিল সম্পাদন করা হয়।
ক্রেতাদের দাবি, এটি নওয়াবদের পারিবারিক সম্পত্তি। নওয়াবের উত্তরসূরি হামদে আলী ও হাম্মাদ আলী চৌধুরীর নামে খারিজ হয়েছে। তাঁরাই সম্পত্তি বিক্রি করেছেন।
ওই সময় অভিযোগ ওঠে, শহরের সার্কিট হাউসসংলগ্ন ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ সম্পত্তির বাজারমূল্য গড়ে কোটি টাকা। সেই হিসাবে নওয়াব প্যালেসের বাজারমূল্য কমপক্ষে দেড় শ কোটি টাকা। অথচ মাত্র ২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।
শহরের সাতমাথাসংলগ্ন করতোয়া নদীর ডান তীর ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস’ নামের নওয়াববাড়ি বগুড়াবাসীর কাছে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে টিকিট কেটে নওয়াব প্যালেস, প্যালেস মিউজিয়াম ও ভেতরের বিনোদনকেন্দ্র ঘুরে দেখতেন।
বগুড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন—এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমিদার আবদুস সোবহান চৌধুরীর মেয়ে আলতাফুন্নেছাকে বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী। আবদুস সোবহান মারা গেলে নাতি নওয়াব আলতাফ আলী জমিদারি ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতোয়ালি নিযুক্ত হন। আলতাফ আলীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী মোতোয়ালি হন। মোহাম্মদ আলী চৌধুরী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৩ সালে। মোহাম্মদ আলীর অবর্তমানে নওয়াব পরিবারের সদস্যরা ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেন। বিক্রি করে দেওয়া ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর গড়ে ওঠে নওয়াববাড়ি সড়কের টিএমএসএস মহিলা মার্কেট, আল আমিন কমপ্লেক্স, শেখ শরীফ উদ্দিন সুপার মার্কেট, র্যাংগস ভবন ও রানার প্লাজা। অবশিষ্ট জায়গার ওপর ‘মোহাম্মদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম অ্যান্ড পার্ক’ ছিল।
নওয়াববাড়ি বিক্রির তৎপরতা নিয়ে প্রথম আলোতে ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর ‘বিক্রি হয়ে যাচ্ছে নওয়াববাড়ি’ এবং ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ‘বগুড়ার ঐতিহ্য কি হারিয়ে যাবে?’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।