শিশুরা যেখানে ফিরে পাচ্ছে নতুন জীবন

ময়মনসিংহের ফুলপুরের স্কুলশিক্ষক এ কে এম আবদুর রাজ্জাক দুই দিন বয়সী ছেলেকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ছেলে জন্ম নিয়েছে জন্মগত হার্নিয়া নিয়ে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ছেলেকে নিয়ে পৌঁছান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে। হাসপাতালেই ছিলেন এক মাস। আশা ছেড়ে দেওয়া সেই ছেলে ফাহিম নূর নিশাত এখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

আবদুর রাজ্জাক বেশ গর্ব নিয়েই বললেন, ‘হাসপাতালের টাবলু স্যারসহ অন্যান্য স্যারের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। এই স্যারেরা সাড়ে ৩ ঘণ্টা অপারেশন করে আমার ছেলেকে ভালো করেন। আমার ছেলের ছবি এক ম্যাগাজিনেও দিয়েছিলেন স্যারেরা। চিন্তা করি নাই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব, তবে হাসিমুখেই বাড়ি ফিরেছি আমরা।’

আবদুর রাজ্জাক বলছিলেন ২০০৩ সালের কথা। আবদুর রাজ্জাকের ছেলের অস্ত্রোপচার করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগ। ছবি: আবদুস সালাম

২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরায় যুবলীগের সংঘর্ষের সময় মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সুরাইয়া। ওই দিন রাতেই মাগুরা সদর হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় সুরাইয়ার মা নাজমা বেগমের। সন্তান প্রসবের পর দেখা যায় পেটে থাকা শিশুটিও গুলিবিদ্ধ। গুলি মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর শরীরও এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলে। দুদিন পর মা ও নবজাতককে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালেই তার নাম রাখা হয় সুরাইয়া।

সুরাইয়া ও তার মা-বাবার অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের বর্তমানে শিশু সার্জিক্যাল অনকোলোজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি। শুধু সুরাইয়ার অস্ত্রোপচার করা নয়, এখন পর্যন্ত সুরাইয়াকে নিয়ে কবে ঢাকায় ফলোআপে আসতে হবে, কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, সব ঠিক করে দেন এই অধ্যাপক। আর সুরাইয়ার মা-বাবাও তা মেনে নেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে অনেক শিশুই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

২০১৯ সাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচিত মুখ তিন বছর বয়সী তোফা ও তহুরা। তারা এখন একা একা হাঁটে। নাচে। খেলে বেড়ায়। দুই বোন মারামারি করে। বলতে গেলে তারা এ হাসপাতালেই বড় হচ্ছে। গাইবান্ধা থেকে মা শাহিদা বেগমের সঙ্গে ফলোআপে আসতে হয় তাদের। হাসপাতালে যে কেউ এদের দেখলেই একটু থমকে দাঁড়ান—আরে এরা তো সেই আলোচিত জোড়া লাগানো যমজ শিশু।

২০১৬ সালে জন্মের আট দিনের মাথায় তোফা ও তহুরা জোড়া লাগানো অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিল। পিঠ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জন্মেছিল তারা। জন্মের পর এভাবেই ছিল ১০ মাস।

২০১৭ সালের ১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ২০ থেকে ২২ জন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক ৯ ঘণ্টা যুদ্ধ করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তোফা ও তহুরাকে আলাদা করেন। আর এ কাজেও নেতৃত্ব দেন হাসপাতালটির শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপকেরা। তোফা ও তহুরা শুরু থেকেই শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক সাহনূর ইসলামের অধীনে চিকিৎসাধীন। শুধু চিকিৎসা নয়, তোফা ও তহুরার জন্মদিনে সুন্দর ফ্রক কিনে দেওয়া, ওদের বাবার জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করাসহ অন্যান্য দায়িত্বও পালন করেন সাহনূর ইসলাম।

এভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে অনেক শিশুই নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। মা-বাবার মুখের উদ্বেগের ছাপ মুছে গিয়ে ফুটেছে অনাবিল হাসি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু সার্জারি বিভাগের যাত্রা শুরু ১৯৯৩ সালে। জন্মগত ত্রুটিসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে দৈনিক গড়ে ১২ থেকে ১৫ জন শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি হচ্ছে। বহির্বিভাগ ও ডে কেয়ারেও (অস্ত্রোপচারের তারিখ দেওয়ার পর এসে ভর্তি হয়ে দ্রুত বাড়ি ফেরা) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। দিনদিন বাড়ছে সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা। শিশু সার্জারি বিভাগের পরিধি বেড়েছে। বর্তমানে এ বিভাগের অধীনে জেনারেল পেডিয়াট্রিক সার্জারি, নিউনেটাল সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জিক্যাল অনকোলোজি, পেডিয়াট্রিক ইউরোলজি বিভাগ খোলা হয়েছে।

হাসপাতালটির শিশু সার্জারি বিভাগের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কোনো বিছানায় তিনজন বাচ্চাকেও থাকতে হচ্ছে। তিনজন বাচ্চার সঙ্গে একই সঙ্গে থাকছেন তিনজন মা। ফলে পুরো ওয়ার্ডে ঠাঁই নাই অবস্থা। তবে রোগীর স্বজনদের মুখে অভিযোগ কম। যে মায়েরা সন্তানকে বুকে নিয়ে দুই-এক দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন, তাঁদের মুখে হাসি।

১৯৯৩ সালে মাত্র ৫টি শয্যা নিয়ে বিভাগটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে শয্যা সংখ্যা ৫৫ টি। ১০টি ইউনিট, ১৭টি ফ্যাকাল্টিতে ১৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিকিৎসা দিচ্ছেন। এ বিভাগে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা চিকিৎসা পাচ্ছে।

শিশু সার্জারি বিভাগের নিউনেটাল সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলু বললেন, সুস্থ বাচ্চা জন্ম নিলে সবাই মিষ্টি বিতরণ করেন। সুস্থ বাচ্চা জন্ম না নিলেই পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। শুরুর দিকে জন্মগত ত্রুটিসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে আনা হলেও ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই মারা যেত। আর বর্তমানে এ বিভাগ থেকে ৯০ জনই বেঁচে যাচ্ছে। এ বিভাগে নবজাতকদের জন্য নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ থাকলে বেঁচে বাড়ি ফেরার হার আরও বাড়ত।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগ অনেকটা শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে। ছবি: প্রথম আলো

ফুলপুরের শিক্ষক এ কে এম আবদুর রাজ্জাক অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলুর কথাই বলছিলেন। এই অধ্যাপক বললেন, ‘পায়খানার রাস্তা নেই, খাদ্যনালির সমস্যা, পেটের নাড়ি বাইরে বের হয়ে এসেছে—এ ধরনের বাচ্চাদের ভর্তি করা হচ্ছে বিভাগে। ওই সময় অস্ত্রোপচার না করলে বাচ্চাগুলো মারা যেত। অথচ একটি অস্ত্রোপচারে ওই শিশুই বড় হয়ে ৯০ বছর পর্যন্তও বেঁচে থাকছে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আশরাফ উল হক বললেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগ অনেকটা শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে। বেশির ভাগ শিশু আসেই মুমূর্ষু অবস্থায়। তাদের ফিরিয়ে দিলে তারা কোথায় যাবে? এক বিছানায় ৬ জনকে থাকতে হলেও রোগী ও তার স্বজন থাকছেন ভাগাভাগি করে। সরকারের সহায়তায় উন্নত যন্ত্রপাতিসহ বিভাগটির বিভিন্ন উন্নয়ন হয়েছে।’

অধ্যাপক আশরাফ উল হক বললেন, গত কয়েক বছরে মাগুরার গুলিবিদ্ধ শিশু, জোড়া লাগানো তোফা ও তহুরাকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা এবং তাদের বেঁচে থাকার ঘটনা নজির স্থাপন করেছে। কুকুরে খেয়ে ক্ষতবিক্ষত করেছিল যে নবজাতককে, সেও এখন ভালো আছে। বিষয়গুলোই আশা আর আনন্দের। শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপকেরা নেতৃত্ব দিলেও নবজাতক বিভাগ, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের সম্মিলিত উদ্যোগের ফলেই এ সাফল্য এসেছে এবং তা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।

বিভাগটির চ্যালেঞ্জ অনেক বলেও উল্লেখ করলেন অধ্যাপক আশরাফ উল হক। বললেন, নবজাতক ছাড়া এই বিভাগে মৃত্যু হার ২ শতাংশেরও কম। তবে নবজাতক যোগ করলে তা ৭ থেকে ৮ শতাংশ হয়ে যাচ্ছে। নবজাতকদের প্রায় ১৮ শতাংশই মারা যাচ্ছে। নবজাতকদের জন্য আইসিইউ জরুরি। শয্যা সংখ্যা বাড়ানো না গেলে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জনবলেরও সংকট আছে।

কানিজ হাসিনা শিউলি বললেন, ‘সুরাইয়াকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সময়মতো না আনলে তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যেত। এখনো সুরাইয়া এক চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু বেঁচে তো আছে। ওর বাবা-মা আমার রুমে এসে যখন হাসেন, তখন মনে এক ধরনের প্রশান্তি পাই।’

দিনদিন বাড়ছে সেবা পাওয়া শিশুর সংখ্যা। ছবি: আবদুস সালাম

সম্প্রতি তোফা ও তহুরাকে পাওয়া গেল অধ্যাপক সাহনূর ইসলামের রুমে। সাহনূর ইসলামের সঙ্গে খেলা শুরু করে তারা। নাচ দেখায়। একটু পর এই অধ্যাপকের রুমের সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়ল তোফা ও তহুরা।

অধ্যাপক সাহনূর ইসলাম জানালেন, তোফা ও তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। বাংলাদেশে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটি প্রথম। তোফা ও তহুরার পেটে অস্ত্রোপচার করে পায়খানার রাস্তা তৈরি, অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা, আলাদা পায়খানা ও মাসিকের রাস্তা তৈরি, পেটের পায়খানার রাস্তা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন কিছু করতে হয়েছে। তোফা ও তহুরা এখন অন্যান্য আট-দশটি মেয়েশিশুর মতোই ভবিষ্যতে বিয়ে করা, সন্তান জন্ম দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই করতে পারবে। তবে ওদের ফলোআপে থাকতে হবে বলে জানালেন এই অধ্যাপক।

সরকারি খরচে তোফা ও তহুরার চিকিৎসার পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন তোফা ও তহুরার বাবা রাজু মিয়ার জন্য হাসপাতালের বাগানে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

তোফা ও তহুরার মা শাহিদা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার মেয়েরা এখন হাঁটে। নাচে। কথা বলে। বুঝতেই পারতেছেন—এখন আমি কত খুশি। যে কষ্ট করছি জোড়া লাগা মেয়ে দুইটারে নিয়া। এই হাসপাতালে আনার পর ম্যাডাম সাহনূর ইসলামই তো ভালো করলেন আমার মেয়ে দুইটারে।’