আবহমান কাল থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা চৈত্র মাসের শেষ দিন নানা পূজা আয়োজনের মধ্য দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে আসছেন। এ জনপদে চৈত্রসংক্রান্তির দিন নীল পূজা ও চড়ক পূজা পালনের রীতি রয়েছে। বিদায়ী বছরের গ্লানি, ব্যর্থতা ও রোগমুক্তি কামনায় গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে নীল পূজার আয়োজন করা হয়।
নীল পূজার অর্থ সংগ্রহের জন্য ৮ থেকে ১২ জনের একটি দল গঠন করা হয়। দলের সদস্যরা শিব, পার্বতী, রাধা, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, রাম, লক্ষ্মণ, মুনি সেজে হাটবাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে নেচে-গেয়ে নীল পূজার অর্থ সংগ্রহ করেন। অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি ধর্মীয় সংগীত আর নৃত্য পরিবেশন করে গ্রামবাংলার মানুষকে বিনোদন দিয়ে থাকে এই দলের সদস্যরা।
সরকারিভাবে ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হলেও পঞ্জিকা অনুযায়ী আজ রোববার চৈত্র মাসের শেষ দিন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পঞ্জিকা মেনে আজ চৈত্রসংক্রান্তি পালন করছেন। এই দিন গ্রামের বাড়ির আঙিনায় মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠানসহ অনুষ্ঠিত হয় নীল পূজা।
পৌরাণিক ধর্ম মতে, দেবতারা সমুদ্র মন্থন করলে বিষ উঠে আসে। তখন দেবতা শিব দেখলেন এই বিষ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র প্রাণিকুল মারা যাবে। তখন তিনি নিজে বিষ পান করে কণ্ঠে ধারণ করেন। বিষক্রিয়ায় তাঁর কণ্ঠ নীল বর্ণ হয়ে যায়। এ কারণে শিবের অপর নাম নীলকণ্ঠ। প্রাণিকুলের সুখ-সমৃদ্ধির কামনায় চৈত্র মাসের শেষ দিন শিবের গাজন বা নীল পূজা পালন করা হয়। মূলত চৈত্রসংক্রান্তির দিন বছরের বিদায়বেলায় মানুষ অতীতের দুঃখ, কষ্ট, ব্যর্থতা, রোগ, বিপদ আপদ থেকে মুক্তির কামনা করে।
গতকাল শনিবার বিকেলে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মধ্য জয়পুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বর্ণিল সাজে নানা দেবদেবীর রূপে ১০ জনের একটি নীল দল বাদ্যের তালে তালে নেচে–গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দলের বেশির ভাগ সদস্য কিশোর, তরুণ ও যুবক। তাঁরা বাড়িতে গিয়ে গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করে ধর্মীয় ও বাউল গান এবং নৃত্য পরিবেশন করেন। গান পরিবেশনের পর গৃহস্থরা তাঁদের চাল, ধান, ডাল, সবজিসহ নগদ অর্থ দেন।
নীল দলের সদস্য পার্থ মিস্ত্রি বলেন, ‘নীল দলে রাধা, কৃষ্ণ, লক্ষ্মণ, পার্বতী, শিব, লক্ষ্মী ও রাম সেজে আমরা অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী নিচ্ছি। আমরা নৃত্যের সঙ্গে ধর্মীয় সংগীত, বাউলগান পরিবেশন করি। এ ছাড়া রামায়ণ ও মহাভারতের গানও গাওয়া হয়।’
উপজেলার মধ্য জয়পুর গ্রামের শ্রী গুরু নাট্য সংঘের সভাপতি নিরঞ্জন হাওলাদার বলেন, ‘প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের অর্থ সংগ্রহের জন্য হাটবাজার ও গ্রামে ঘুরে গান নাচ করে টাকা ও উপঢৌকন আদায় করি। উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া টাকা ও খাদ্য দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তির দিন চড়ক পূজা, শিবের গাজন বা নীল পূজা পালন করি।’