মামলাটির বাদীর নাম মুস্তারী জাহান। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাঘার তেঁথুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখার দাবিতে মামলা করেন এক শিক্ষার্থী। তা না দেখাতে শিক্ষা বোর্ড মামলাটি হাইকোর্টে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মামলাটি আবার নিম্ন আদালতে আসে। ১৬ বছর চলছে সেই মামলা।
মামলাটির বাদীর নাম মুস্তারী জাহান। এতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড, বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষাকেন্দ্রের সচিবকে বিবাদী করা হয়। আগামী ১ নভেম্বর মামলাটি ১৭ বছরে পড়বে। ২০ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
মুস্তারী রাজশাহীর বাঘা উপজেলার তেঁথুলিয়া গ্রামের মুনসুর রহমানের মেয়ে। ২০০৪ সালে তেঁথুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন মুস্তারী। এতে তাঁকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। সে সময় নাবালিকা থাকায় তাঁর পক্ষে আদালতে মামলা করেন বাবা মুনসুর।
আরজিতে বলা হয়, ২০০৪ সালের এসএসসির ফল প্রকাশিত হয় ২৬ জুন। মুস্তারী খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেন। তাতেও কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে ১ নভেম্বর রাজশাহীর আদালতে মামলা করা হয়। এতে বলা হয়, মুস্তারী বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষায় ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করেন। ওপরের কভার ঠিক রেখে উত্তরপত্র বদল করার কারণে তাঁর ফলাফল অকৃতকার্য এসেছে।
এই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান, যাতে আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে এ অভিশাপ না নেমে আসে।মুস্তারী জাহান, মামলার বাদী
মুস্তারীর বাবা মুনসুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, মামলাটি আমলে নিয়ে আদালত উত্তরপত্র হাজির করার নির্দেশ দেন। আদালত মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উত্তরপত্র নষ্ট না করার ব্যাপারেও আদেশ দেন। এ জন্য তিনি আদালতের নির্দেশে ট্রাংক ও তালাচাবি কেনার জন্য নির্ধারিত ফি জমা দেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে শিক্ষা বোর্ড হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন করে। সেখানেও নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখা হয়। পরে শিক্ষা বোর্ড আপিল বিভাগে যায়। ২০০৯ সালের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রেখে উত্তরপত্র হাজির করার নির্দেশ দেন। মামলার ৭ বছর পর ২০১১ সালে শিক্ষা বোর্ড আদালতকে জানায়, ছয় মাসের বেশি শিক্ষা বোর্ডে উত্তরপত্র সংরক্ষণ করা হয় না। তবে এ শিক্ষার্থীর খাতার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু না বলায় ২০১১ সালের ২১ জুন আদালত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে পরবর্তী ধার্য দিনে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। চেয়ারম্যান সশরীরে হাজির হতে পাঁচ বছর সময় নেন। তারপরও খাতা দেখানো হয়নি। বর্তমানে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বাদীপক্ষ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে।
সাবালিকা হওয়ার পর মামলাটির বাদী হন মুস্তারী জাহান। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মামলা করার পরের বছর ওই কেন্দ্রের শিক্ষক দিয়ে তাঁকে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতে বাধা দেওয়া হয়। কোনো উপায় না দেখে রসায়ন পরীক্ষার আগে বিষয়টি ইউএনওকে জানান তিনি। ইউএনও তাঁকে পরীক্ষাকেন্দ্রের বারান্দায় একা একটি বেঞ্চে বসিয়ে আলাদা করে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ইউএনও পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারান্দার নিচে বসেছিলেন।
মুস্তারী দাবি করেন, খারাপ শিক্ষার্থী প্রমাণ করার জন্য পরেরবারও তাঁর উত্তরপত্র পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ফলে তাঁর ফলাফল আবার খারাপ হয়। তিনি কোনোমতে পাস করেন। হতাশ হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে এ গ্রেড পেয়ে পাস করেন। এসএসসির ফল খারাপ হওয়ার কারণে তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারেননি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে। তবে তিনি এই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চান, যাতে আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে এ অভিশাপ না নেমে আসে।
জানতে চাইলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল ইসলাম বলেন, এটা তাঁর সময়ে হয়নি। অনেক আগের কথা।
বিবাদীপক্ষের আইনজীবী এজাজুল হক বলেন, তাঁরা আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর রয়েছেন। আদালত যে রায় দেবেন, সেটাই তাঁরা মেনে নেবেন।