সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙালেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আজ বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে তিনি শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৪ মিনিটে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে আসেন। এরপর ৪টার দিকে তিনি অনশনস্থলে যান। সেখান গিয়ে তিনি অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হকও সঙ্গে ছিলেন।
১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে এ আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।
আজ আন্দোলনের ১৪তম দিন। প্রথম ছয় দিনে দাবি পূরণ না হওয়ায় ১৯ জানুয়ারি বেলা তিনটা থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী। তাঁদের একজনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ি চলে যান তিনি। গত শনিবার রাত আটটা থেকে আন্দোলনরত আরও পাঁচ শিক্ষার্থী অনশনরতদের সঙ্গে যোগ দিয়ে গণ-অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। যাঁরা হাসপাতালে ছিলেন, তাঁদের হাসপাতাল থেকে আজ সকালে আনা হয়। অন্যরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনে ছিলেন। সব মিলিয়ে অনশনরত ২৭ শিক্ষার্থী আজ অনশন ভাঙেন। আরেক অনশনকারী অস্ত্রোপচারের কারণে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করার পর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শ শিক্ষক একাধিকবার শিক্ষার্থীদের অনশন প্রত্যাহার করে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এমনকি গতকাল সন্ধ্যায় আন্দোলনরত কয়েক শ শিক্ষার্থী অনশন থেকে সরে আসার ‘সম্মিলিত অনুরোধ’ জানালেও তাঁরা সেই আহ্বান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
গতকাল রাতে শাবিপ্রবিতে প্রবেশের পর প্রায় দুই ঘণ্টা মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনশনকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি অনশনস্থলে পৌঁছে প্রথমেই অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের বিষয়ে তাঁকে বিস্তারিত জানান। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক অনশনকারী শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের অনশন থেকে সরে আসার জন্য বোঝাতে থাকেন। অনশনকারীদের উদ্দেশে এ সময় মুহম্মদ জাফর ইকবালকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমরা জানো না কত বড় আন্দোলন তোমরা করেছ। এখন সব বিশ্ববিদ্যালয় কাঁপছে। তোমরা যেটা চেয়েছ, সেটা পাবে। এটা তোমাদের ক্যাম্পাস। তোমরা যেভাবে সাজাতে চাও, এই ক্যাম্পাস সেভাবে সাজানো হবে। কিন্তু এখন অনশন ভাঙতে হবে। তোমাদের আন্দোলনের কারণে ৩৪ জন ভাইস চ্যান্সেলরের ঘুম নেই। তোমরা অনশন না ভাঙলে আমিও যাব না। এখানেই থাকব। তোমাদের না খাইয়ে আমি যাব না।’
অনশনকারী এবং আন্দোলনকারীরা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের নানা সমস্যার বিষয়ে অবহিত করেন। এ সময় পুলিশের মারধর নিয়ে শিক্ষার্থীরা মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, পুলিশ বেধড়ক মারধর করে উল্টো শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে। এসব শুনে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আশ্বাস দিচ্ছি, মামলা প্রত্যাহার হবে।’
মুহম্মদ জাফর ইকবাল আজ সকাল ছয়টা পর্যন্ত অনশনকারীদের সঙ্গে ছিলেন। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর একটা স্মারকগ্রন্থের জন্য আমার কাছে একটা লেখা চাওয়া হয়েছিল। সেই লেখাটার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হয়েছে। আমি এই সম্মানীর টাকাটা নিয়ে এসেছি। এই আন্দোলনের ফান্ডে টাকাটা দিচ্ছি। তোমরা রাখো। এবার পারলে আমাকে অ্যারেস্ট করুক।’ এরপর মুহম্মদ জাফর ইকবাল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন। এ সময় তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি চরম অমানবিক বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, মুহম্মদ জাফর ইকবাল শাবিপ্রবির অধ্যাপক হিসেবে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর অবসরে যান। এর আগে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অবসরের পর তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। গতকাল রাতে ঢাকা থেকে সড়কপথে তিনি সিলেটে আসেন।