শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দিলশাদ বিশ্বাসের নামে রাজশাহী জেলা পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগারের নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ পুলিশ সদস্যদের জন্য যে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে, তাতেও দিলশাদ বিশ্বাসের নাম রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাঁরাও তাঁর অবদানের কথা বলছেন। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নামের বইয়ে তাঁর নাম রয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত দিলশাদ বিশ্বাসের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়নি।
রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মান্নান বলেন, রাজশাহী পুলিশ লাইনসে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়েছে, সেখানে ৯ নম্বর ক্রমিকে দিলশাদ বিশ্বাসের নাম রয়েছে। তিনি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো তদবিরের ঘাটতি থাকার কারণে তাঁর নামটি গেজেটভুক্ত হয়নি।
গোদাগাড়ী থানার শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রাজশাহী পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে ১৮ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন। এসআই দিলশাদ বিশ্বাস তখন রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় কর্মরত ছিলেন। ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহুরুল ইসলাম ঘটনার কয়েক দিন আগে সরকারি কাজে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। এসআই দিলশাদ বিশ্বাস থানার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি থানার সিপাহিসহ এলাকার ৪০ জন কিশোর-তরুণকে নিয়ে থানাসংলগ্ন স্কুলমাঠে অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা করে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। দিলশাদ বিশ্বাস ২৮ মার্চের পর থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত থানায় পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে নিজের মতো বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করে উত্তোলন করেন। অবশ্য সেই পতাকার মাঝে লাল সূর্য ছিল না।
দিলশাদ বিশ্বাসের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মো. শাহজাহান। শাহজাহান পরে রাজশাহী মহানগর পুলিশের আর্মড ইন্সপেক্টর হয়েছিলেন। তিনি ২০১৭ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। ৭ ডিসেম্বর মো. শাহজাহানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। প্রশিক্ষণ নিলেও বয়স কম হওয়ার কারণে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা দলে নেননি। তাঁর চেয়ে বয়সে যাঁরা বড় ছিলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দিলশাদ বিশ্বাসের ছোট মেয়ে দেলোয়ারা বেগমের বয়স ছিল ১৪ বছর। দেলোয়ারা বেগম বলেন, বাবা সেই দিন (২১ এপ্রিল, ১৯৭১) বাসায় খেতে বসেছিলেন। একজন সিপাহি এসে পাকিস্তানি বাহিনী আসার খবর দেন। তিনি বাবাকে পদ্মা পার হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বাবা পালিয়ে যেতে রাজি হলেন না। চ
দিলশাদ বিশ্বাসসহ আরও কয়েকজনকে পাকিস্তানি বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। ২৩ এপ্রিল দিলশাদ বিশ্বাসের ছেলের বড় ছেলে আয়নাল হক, কনস্টেবল জাকির হোসেনের ছেলে আলাউদ্দিন, আবদুর রউফের ছেলে মো. মন্টু তাঁদের বাবার খোঁজে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যান। সেখানে না পেয়ে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে আসেন। তবে দিলশাদ বিশ্বাসের লাশ পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতার পর দিলশাদের স্ত্রী শাহজাদী বেগম দুই ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে দুঃখ–কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান। তাঁর আগেই দুই ছেলে মারা গেছেন। এখন তাঁর চার মেয়ে বেঁচে আছেন। তাঁদের মধ্যে দেলোয়ারা বেগম থাকেন রাজশাহী নগরের টিকাপাড়া এলাকায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবার স্বীকৃতির জন্য এখনো লড়াই করে যাচ্ছেন। দেলোয়ারা বেগমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তদন্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১৪ মে পুলিশ সদর দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এখনো সেই স্বীকৃতি মেলেনি।