টাঙ্গাইলে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শর্ষের আবাদ হয়েছে। জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন শর্ষে ফুলের হলুদ রঙের সমারোহ। শর্ষের এসব জমির পাশেই মৌ চাষের বাক্স বসিয়েছেন চাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে শর্ষে ফুলের পরাগায়নে সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে শর্ষের উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। সমন্বিত এই চাষে শর্ষেচাষি ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলায় এ বছর ৪৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে শর্ষে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। এবার জেলায় ৫০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর জমিতে শর্ষের আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৯০০ হেক্টর বেশি। এসব খেতের পাশে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ৯৮৫টি মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করা হয়েছে। এর সংখ্যা আরও বাড়বে। এসব বাক্স থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৯৫০ কেজি মধু আহরণ করা হয়েছে। আরও অন্তত ২০ দিন বিভিন্ন এলাকায় মধু আহরণ চলবে বলে মৌচাষিরা জানিয়েছেন।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, উচ্চফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের শর্ষে কৃষকেরা চাষ করেন। দুই জাতের শর্ষে নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাতভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন।
টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, কালিহাতী, ভূঞাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক দিন ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন শর্ষে ফুলের সমারোহ। কৃষকেরা যেমন মাঠে শর্ষের পরিচর্যা করছেন, তেমনি খেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা।
বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার গালা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শর্ষেখেতের পাশে ১৫০টি মৌ চাষের বাক্স স্থাপন করেছেন হাবিবুর রহমান। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা থেকে তিনি এসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য। এই বাক্সগুলো থেকে গত ১ মাসে তিনি ৩৫ মণ মধু সংগ্রহ করেছেন। আরও ১৫ থেকে ২০ মণ মধু আহরণ করতে পারবেন বলে তিনি আশা করছেন।
হাবিবুর রহমানের মতো সদর উপজেলার কুইচবাড়ি গ্রামে রবিউল ইসলাম ১৮০টি বাক্স, পিচুরিয়া গ্রামে মুন্না মিয়া ৩০০ বাক্স বসিয়েছেন। নাগরপুরের ধুবরিয়া গ্রামে ১৫০টি বাক্স স্থাপন করেছেন সাতক্ষীরার নাজমুল হাসান। একই উপজেলার তিরছা বটতলা এলাকায় ১০০ বাক্স স্থাপন করেছেন মাজেদুর রহমান। তাঁরা বলেন, সাতক্ষীরা থেকে টাঙ্গাইল অঞ্চলে শর্ষে ফুলের মধু সংগ্রহের জন্য অর্ধশতাধিক মৌমাছি খামারি এসেছেন। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের মৌচাষিরাও মধু সংগ্রহ করছেন।
দেলদুয়ার উপজেলার জাঙ্গালীয়া কবরস্থানের পাশে ৮৭টি বাক্স বসিয়েছেন এই উপজেলার মৌচাষি সাইফুর রেজা। তিনি বলেন, সংগ্রহ করা মধু ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়। তবে এখন স্থানীয় পর্যায়েও বাজার গড়ে উঠেছে। মধু সংগ্রহের স্থানে এসে অনেক মানুষ মধু কিনে নিয়ে যান। এ বছর স্থানীয়ভাবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি হচ্ছে, তবে পাইকারি মূল্য ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত উঠছে।
কয়েকজন শর্ষেচাষি জানান, শর্ষেখেত থেকে মধু আহরণ করলে পরাগায়ন হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে। তাই তাঁরা মৌচাষিদের মধু আহরণে উৎসাহিত করেন এবং সহযোগিতাও করেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন মৌচাষ উন্নয়ন সংস্থার সূত্র জানায়, টাঙ্গাইল অঞ্চলে ৭০০ থেকে ৮০০ জন প্রশিক্ষিত মৌচাষি রয়েছেন। তাঁরা শর্ষেখেত থেকে মধু সংগ্রহ করায় শর্ষের উৎপাদন বাড়ছে। পাশাপাশি মধু আহরণ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারছেন।
মৌচাষি সাইফুর রেজা জানান, মধু আহরণের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মধু সংরক্ষণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে মৌচাষিরা আরও বেশি লাভবান হতে পারবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আহসানুল বাশার জানান, মৌমাছি শর্ষে ফুলে ফুলে উড়ে মধু সংগ্রহ করে। এতে শর্ষে ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই শর্ষেখেতের পাশে মৌচাষের বাক্স স্থাপন করলে শর্ষের ফলন অনেক বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি মৌচাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হন।