ঝালকাঠিতে যাত্রীবাহী লঞ্চ অভিযান–১০–এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, দেশের লঞ্চগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের অবস্থা খুবই নাজুক। যদিও সার্ভে সনদের শর্তে বলা আছে, লঞ্চের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা থাকা বাঞ্চনীয়। কিন্তু বাস্তবে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে যাত্রী পরিবহনকারী লঞ্চগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বা ফায়ার ইস্টিংগুইশার নেই। লঞ্চকর্মীদের জন্য নেই আগুন নেভানোর কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। লঞ্চের ছাদে লাইফবোট থাকার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ লঞ্চে তা নেই।
দেশে প্রতিবছর নৌযান দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানি ঘটে, যার বেশির ভাগই নৌযানডুবির ঘটনা। তবে এবার এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌ দুর্ঘটনা নতুন রূপ পেল। এত দিন নৌপথে যাত্রীদের নিরাপত্তায় শুধু বয়া ও লাইফজ্যাকেটের বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতির বিষয়টি এক রকম উপেক্ষিতই ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল সংস্থার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর লঞ্চগুলোকে সার্ভে সনদ নিতে হয়। এসব সরঞ্জাম না থাকলে সনদ দেওয়া হয় না। তবে কিছু কিছু লঞ্চে এ ক্ষেত্রে গাফিলতি থাকতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। নিখোঁজ অন্তত ৫১ জন।
অভিযোগ আছে, এমভি অভিযান–১০ লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ছিল না। ফলে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারীরা আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা না করেই লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন। আগুন নেভানোর জন্য তাঁদের ছিল না কোনো প্রশিক্ষণও। যে কারণে প্রাণহানি ও দগ্ধের সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঢাকা-বরগুনা নৌপথে চলাচল করে এমভি ফারহান-৮, শাহরুখ-২, পূবালী-১, রাজহংস-৮, অভিযান-১০ ও রাজারহাট বি—এই ছয়টি লঞ্চ। আমতলী-ঢাকা নৌপথে চলে সুন্দরবন-৭, ইয়াদ-১ ও তরঙ্গ-৭। ৪০০-এর ওপরে ধারণক্ষমতার এই ৯ লঞ্চের কোনোটিতেই নেই শর্ত অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। একইভাবে বরিশাল-ঢাকা নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চগুলো বিলাসবহুল হলেও এসব লঞ্চেও রয়েছে অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ঘাটতি। এসব লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৮০০-এর ওপরে।
গত শনিবার দুপুরে বরগুনা নৌবন্দরে নোঙর করা এমভি শাহরুখ-২ ও ফারহান-৮ লঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, এমভি ফারহানে ১৮টি বালতি এবং ইঞ্জিনকক্ষ, কেবিনের করিডর ও মাস্টার কক্ষে বিই শ্রেণির ১৩টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে। তবে এমভি শাহরুখ-২ লঞ্চটিতে ১৮টি বালতি এবং ইঞ্জিনকক্ষ ও ক্যানটিনে পাঁচটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখা গেলেও অন্যান্য স্থানে কোনো অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম নেই। তবে দুটি লঞ্চেই পাম্প আছে। লঞ্চটির পরিদর্শক এনায়েত হোসেন বলেন, ‘ইঞ্জিনকক্ষ ও ক্যানটিন ছাড়া অন্য কোথাও অগ্নিনির্বাণ যন্ত্র থাকতে হবে—এমন বিধান নেই কাগজপত্রে।’
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২০০১ সালের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ৪০০ থেকে ৮০০ যাত্রী ধারণক্ষমতার লঞ্চে ২০ ঘনমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফায়ার পাম্প থাকতে হবে এবং পাম্পটি স্বতন্ত্রভাবে চলার সুবিধা থাকতে হবে। পাম্প থেকে ১৫ মিটারের দুটি হোস পাইপ দিয়ে যাতে লঞ্চের ডেকে ওয়াটার জেট নিক্ষেপ করা যায়, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। একইভাবে ইঞ্জিনকক্ষে দুটি হাইড্রান্ট, ৯ লিটার ধারণক্ষমতার বিই শ্রেণির ৮টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এবং যন্ত্রপাতি রাখার স্থানে আরও ৪টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকতে হবে।
এ ছাড়া কেবিনের করিডর দৈর্ঘ্যে ৩০ মিটারের কম হলে একটি করে, ৩০ মিটারের বেশি হলে দুটি করে, সার্বিকভাবে প্রতি ১০০ বর্গমিটারে একটি করে, প্রত্যেক নাবিকের কক্ষে একটি করে এবং কিচেনে দুটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকতে হবে। ডেকের আবাসনে ৯ লিটার ধারণক্ষমতার এবি শ্রেণির অন্যূন ১০টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকা বাঞ্চনীয়। ৫০ লিটার ধারণক্ষমতার বালুভর্তি ২টি বাক্স, ৪টি অগ্নিকুঠার, ৯ লিটার ধারণক্ষমতার ১২টি বালতি ও রশি থাকতে হবে। তবে ৮০০–এর বেশি যাত্রীবহনকারী লঞ্চগুলোর জন্য এই সরঞ্জাম আরও বেশি রাখতে বলা হয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতে এসব সরঞ্জাম যথাযথভাবে নেই। ঢাকা-বরিশাল নৌপথে চলাচলকারী পারাবাত-১১ ও পারাবাত–১৮ লঞ্চ দুটিতে গিয়ে দেখা যায়, ইঞ্জিনকক্ষে কয়েকটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও বাইরে নেই। কয়েকটি বালতি ছাড়া এই লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণের আর কোনো ব্যবস্থাই নেই। তবে সুরভী-৯, সুন্দরবন–১০, কীর্তনখোলা-১০, অ্যাডভেঞ্চার-১ ও মানামী—এই লঞ্চগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা শর্ত অনুযায়ী রয়েছে।
এ ব্যাপারে সাইদুর রহমান বলেন, ‘অভিযান–১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের নৌযান খাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য অ্যালার্মিং। ইতিমধ্যে আমরা ঢাকা-বরিশাল নৌপথের লঞ্চগুলোতে রাডার, ইকোসাউন্ড সিস্টেমসহ অনেক আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন করেছি। এখন অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে আরও আধুনিক কোনো সরঞ্জাম থাকলে সেটাও আমরা সংযোজন করব। বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের অ্যালার্মিং সিস্টেম সংযোজনের কথা ভাবছি। তবে এখন থেকে লঞ্চমালিক ও স্টাফদের অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে।’
এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে—এটা সত্য। চলমান তদন্তেও সেটা এসেছে। ঝালকাঠির দুর্ঘটনার পর আমরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এখন থেকে লঞ্চ ছাড়ার আগে ভয়েস ডিকলারেশন দেওয়ার সময় এসব ঠিকঠাক আছে কি না, তা যাচাই করা হবে।’