কক্সবাজার সৈকতে নামার ফটকে ব্যারিকেড। বন্ধ আছে দোকানপাট
কক্সবাজার সৈকতে নামার ফটকে ব্যারিকেড। বন্ধ আছে দোকানপাট

লকডাউনে কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

করোনার সংক্রমণ রোধ ও সর্বাত্মক লকডাউনের প্রভাবে গত ৪৫ দিনে কক্সবাজারে পর্যটন ব্যবসায় অন্তত এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল–রেস্তোরাঁ, দুই শতাধিক শুঁটকি ও শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি পণ্য বেচাবিক্রির দোকানপাটসহ পর্যটন–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে এই ক্ষতি হয়েছে।

এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি হয়েছে হোটেলে, মোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণের দিক থেকে কক্সবাজার এমনিতে ঝুঁকিতে, অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

পর্যটক নেই, খালি ৫০০ হোটেল–মোটেল

সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের তারকা হোটেল সি-গাল। গতকাল শনিবার হোটেলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, হোটেল খোলা, কিন্তু ভেতরে কেউ নেই। হোটেলের অন্তত দেড় শ কক্ষ খালি পড়ে আছে।

হোটেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরুল ছিদ্দিকী হাসান বলেন, ১ এপ্রিল থেকে সৈকতে পর্যটক নেই, হোটেলও খালি পড়ে আছে। হোটেলের কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ খরচসহ নানা খাতে দৈনিক লোকসান যাচ্ছে তিন লাখ টাকা করে।

বিদেশি পর্যটকদের পছন্দের জায়গা মেরিনড্রাইভ সড়কের প্যাঁচার দ্বীপের পরিবেশবান্ধব পর্যটনপল্লি ‘মারমেইড বিচ রিসোর্ট’। এখানে ১০০ জনের রাতযাপনের ৫১টি আধুনিক সুবিধা–সংবলিত কটেজ রয়েছে। সব কটি কক্ষ খালি পড়ে আছে।

রিসোর্টের মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, টানা ৪৫ দিন ধরে পুরো রিসোর্ট খালি পড়ে আছে। তিন শতাধিক কর্মচারীর বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ টানতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মালিক কর্তৃপক্ষকে। প্রতি মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকার বেশি।

কলাতলী সৈকত এলাকার শুধু দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ গড়ে উঠেছে চার শতাধিক। সরেজমিন ঘুরে কোনো হোটেলে অতিথি দেখা যায়নি। অধিকাংশ হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিলের আগেই ৯৫ শতাংশ কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে। বর্তমানে দুই থেকে পাঁচজন করে কর্মচারী হোটেল–মোটেলে অবস্থান করে সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন।

ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ৪৫ দিনে শুধু প্রায় ৭০০ হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস, কটেজ ও রেস্তোরাঁগুলোতে ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি (দৈনিক ১১০ কোটি) টাকা। এর মধ্যে তারকা মানের হোটেল ৪৫টি, মাঝারি মানের হোটেল ১৩০টি। এসব হোটেলে দৈনিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ১ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। পৃথক সাতটি হোটেল মোটেল রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মোর্চা এই ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের আওতাধীন হোটেল–মোটেল ও রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৭০৯। ১ এপ্রিল থেকে সব কটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ।

আবুল কাশেম সিকদার বলেন, লকডাউনে শহরের মার্কেট, দোকানপাট সবই খোলা রেখে শুধু পর্যটন বন্ধ রাখা হাস্যকর। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সমুদ্রসৈকতে সীমিত আকারে হলেও পর্যটকের ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। ধস নেমে আসবে পর্যটন ব্যবসায়। বর্তমানে হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে কর্মচারীদের বেতনসহ দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির আওতাধীন হোটেল–মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ৫২টি। ঈদের ছুটিতে কোনো হোটেল খোলা নেই দাবি করে সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, ‘আমরা করোনার সংক্রমণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তারপরও কর্মচারীদের মানবিক দিক বিবেচনায় নিতে হবে, হোটেল–মোটেল বন্ধ থাকায় ৫২টি হোটেল ও রিসোর্টের অন্তত পাঁচ হাজার কর্মচারী বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ কর্মচারীর এপ্রিল ও মে মাসের বেতন–ভাতাও পরিশোধ হয়নি। তাই সীমিত আকারে হলেও সৈকত খুলে দেওয়া উচিত।’

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস সমিতির সভাপতি ওমর সোলতান বলেন, সমিতির আওতাভুক্ত ৭০টি হোটেল ও গেস্টহাউস দেড় মাস ধরে বন্ধ। ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে অধিকাংশ হোটেল। ব্যবসায় ধস সামলাতে হলে পর্যটন চাঙা রাখার বিকল্প নেই।

হোটেলের মালিকেরা বলছেন, করোনার প্রভাবে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে টানা পাঁচ মাস হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ ছিল। ১৭ আগস্টের পর বন্ধ হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো খোলার প্রস্তুতি নিতেই ৩ মাস চলে গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবসা করেছে হোটেল–মোটেলগুলো। কিন্তু মার্চে এসে আবার শুরু লকডাউন। এতে পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল ও আড়াই শতাধিক রেস্তোরাঁ আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। লোকসান গুনতে গুনতে মালিকেরা হয়রান।

ঈদের আনন্দ মাটি ৩০ হাজার কর্মচারীর

কলাতলীর একটি আবাসিক হোটেলে মাসিক ১৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন পাবনার সাজেদুল করিম। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন শহরের ঝাউতলা এলাকায়, ভাড়া বাসায়। কিন্তু এপ্রিল ও মে মাসের বেতন–ভাতা না পাওয়ায় তিনি ঈদ করতে পারেননি।

সাজেদুল করিম (৪৫) বলেন, মার্চ মাসের বেতন ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল। ১ এপ্রিল থেকে হোটেল বন্ধ। কখন খোলা হবে, তার নিশ্চয়তাও নেই। দুই মাসের ২২ হাজার টাকা বাসাভাড়া বাকি। স্ত্রীর স্বর্ণালংকার বিক্রি এবং ধারদেনায় এত দিন সংসার চালিয়েছেন। ঈদের পরে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তাঁর জানা নেই।

কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক নেই, তাই হোটেল–মোটেলও খালি পড়ে আছে

কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল, গেস্টহাউস ও দুই শতাধিক রেস্তোরাঁয় চাকরি করেন অন্তত ৩০ হাজার কর্মচারী। ৯০ শতাংশ কর্মচারীকে মার্চ মাসের বেতন ধরিয়ে দিয়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। নানা চাপ, আন্দোলন–সংগ্রামের পরও অধিকাংশ কর্মচারীর এপ্রিল ও মে মাসের বেতন–ভাতা পরিশোধ করেনি মালিকপক্ষ। কর্মচারীদের অনেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার–পরিজন নিয়ে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কোনো সহায়তা পাননি তাঁরা। আর্থিক সংকটের কবলে মাটি হলো কর্মজীবী মানুষগুলোর ঈদের আনন্দ।

পুলিশ ও স্থানীয় লাইফগার্ড কর্মীরা বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধে গত ১ এপ্রিল থেকে সৈকতে পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসন। এরপর থেকে টানা ৪৫ দিন ধরে পুরো সৈকত ফাঁকা পড়ে আছে। ঈদের দিন স্থানীয় লোকজনও যেন সৈকতে নামতে না পারেন, সে ব্যাপারে কঠোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ সৈকতে নেমে পড়লেও তাঁদের হুইসেল বাজিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে।