কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ার ৩৮টি শরণার্থীশিবির ও একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তঃসত্ত্বা মা কতজন আছেন বা বাংলাদেশে আসার পর এসব শিবিরে গত দুই বছরে কত রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে, তা নিয়ে সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই। তবে শিবিরগুলোতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তা নিয়ে সরকারের পক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সম্প্রতি উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে শিশুদের উপস্থিতিই বেশি। বিভিন্ন বয়সী শিশু। বয়সে একটু ছোট শিশুদের গায়ে জামা–কাপড়, এমনকি বেশির ভাগ শিশুর পরনে হাফপ্যান্ট পর্যন্ত নেই। বেশ কিছু মেয়েশিশুকেও খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায়। বেসরকারি এনজিওর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একদম ছোট বাচ্চাকে টিকা দিতে আসা বা অন্তঃসত্ত্বা নারীর দেখা মিলল। ব্যাগ নিয়ে শিশুদের স্কুলে যেতেও চোখে পড়ল।
কুতুপালংয়ে একাধিক নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা হয়। কারও কারও সন্তান সংখ্যা ৭ থেকে ৮। তাঁদের ভাষায়, এত সন্তান সংখ্যার কারণ ‘আল্লাহ দিয়েছে’। একাধিক কিশোরী মায়ের সঙ্গে কথা হলো। তাদের মিয়ানমারেই কম বয়সে বিয়ে হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এসে তারা জানতে পেরেছে, আইন অনুযায়ী মেয়েদের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া যায় না।
শিবিরে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা জানালেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সংখ্যা বেশি হলেও রাস্তাঘাটে তাঁদের সেভাবে দেখা মেলে না। এমনকি এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ নারী সন্তান প্রসবের জন্যও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে রাজি হন না। ফলে শিবিরে ঘরের ভেতরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বেশি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বললেন, শিবিরগুলোতে আসলেই কত শিশু আছে বা কতজন মা সন্তান জন্মদানের অপেক্ষায় আছেন, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। তবে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) একটি জরিপ করছে। জরিপের ফলাফল হাতে পাওয়ার পর বলা যাবে আসল সংখ্যা। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার তথ্যে বলা হচ্ছে, এই মুহূর্তে শিবিরগুলোতে প্রায় ৪০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মা আছেন।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা আছে উল্লেখ করে আশরাফুল আফসার বললেন, সরকারের পক্ষ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁরা আসলেই এসব পদ্ধতি গ্রহণে আগ্রহী কি না, তা–ও দেখতে হবে।
শিশুর সংখ্যা কত?
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হত্যা ও নিপীড়নের মুখে সেখান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল সাত লাখের কাছাকাছি। আর এদের মধ্যে বড় অংশই ছিল নারী ও শিশু।
২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর ইউনিসেফের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্যমতে, মিয়ানমার থেকে নতুন আসাসহ বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে ৭ লাখ ২০ হাজার। এদের ৪ লাখ ৫০ হাজারের বয়স ৪ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী। সেই সময় ১ লাখ ২০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মা ও অসুস্থ নারীদের বাড়তি পুষ্টিকর খাবার দেওয়া জরুরি ছিল। গত বছরের মে মাস পর্যন্ত পরিস্থিতি উল্লেখ করে ইউনিসেফের আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে ৬০টি রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশে ২০১৮ সালে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেবে বলে বছরটির জানুয়ারি মাসে উল্লেখ করে। বছরটিতে প্রতিদিন গড়ে কমপক্ষে ১৩০টি শিশু জন্ম নেবে বলেও জানায় সংস্থাটি। জনসংখ্যা, সন্তান জন্মদানের হারসহ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সংস্থাটি শিশু জন্মের এই হিসাব করে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য বলছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মোট হাউসহোল্ড/খানা বা পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার। এর মধ্যে ব্র্যাক কাজ করছে ১ লাখ পরিবার নিয়ে। যা মোট হাউসহোল্ডের ৪৫ শতাংশ। তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ এই দুই সপ্তাহের মধ্যে ওই ১ লাখ পরিবারে অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজারের বেশি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কক্সবাজারে কর্মরত উপপরিচালক চিকিৎসক পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মা নিবন্ধনভুক্ত করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, আরআইএমআইয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মায়ের প্রসব করানো হয়েছে।
শিশুদের ঝুঁকি নিয়ে দ্বিমত নেই
রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে শিশুর সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এই শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে আছে, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউনিসেফের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কক্সবাজারে অবস্থানরত ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশু রাষ্ট্রহীন শরণার্থী অবস্থায় রয়েছে। তারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন এবং হতাশা ও নৈরাশ্যের ঝুঁকিতে আছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থীবিষয়ক সেলের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এতিম শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৮৪১। টেকনাফ-উখিয়ার শরণার্থীশিবিরগুলোয় কর্মরত আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা দানকারী সংগঠনগুলোর জোট ইন্টার সেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) হিসাবে শিবিরগুলোতে ১২ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সীদের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৯২৬। এই বয়সীদের বলতে গেলে তেমন কোনো কাজ নেই।
১৬ আগস্ট ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষা খাতে ৪ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সী ২ লাখ ৮০ হাজার শিশুকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। ১৫ বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী শিশুদের ৯৭ শতাংশ এখনো কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। গত বছর পর্যন্ত ১৫ বছর থেকে ২৪ বছর বয়সী রোহিঙ্গাদের মাত্র ৩ শতাংশ কোনো ধরনের শিক্ষা বা কারিগরি দক্ষতা অর্জন করে।
ইউনিসেফের বিভিন্ন প্রতিবেদন এবং বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো আইনি পরিচয় বা নাগরিকত্ব নেই। বাংলাদেশেও জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করা হচ্ছে না, তাদের বৈধ পরিচয় নেই এবং তাদের শরণার্থী মর্যাদাও নেই।
চলতি বছরের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিবের মানবিক দূত আহমেদ আল মেরাইখি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে দুদিনের সফর করেন। সফর শেষে ইউনিসেফ জানায়, রোহিঙ্গা শিশুদের পেছনে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সম্মিলিত উদ্যোগের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন আহমেদ আল মেরাইখি। আইনি পরিচয় ছাড়া এই শিশুরা পাচারকারী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের অনুকম্পায় জীবন ধারণ করছে বলেও তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।