প্রবারণা পূর্ণিমা

রামুর বাঁকখালীতে ভাসল ‘স্বর্গের জাহাজ’

প্রতিবছর প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়। কক্সবাজারের রামুতে বাঁকখালী নদীতে এবার ভাসানো ‘স্বর্গের জাহাজ’। বৃহস্পতিবার বিকালে
প্রথম আলো

কক্সবাজারের রামুতে বাঁকখালী নদীর দুই তীরে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সমবেত হয়েছিল অন্তত হাজার দশেক মানুষ। উদ্দেশ্য ‘স্বর্গের জাহাজ’ ভাসানো উৎসব উপভোগ করা। ২০০ বছর ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ নদীর এই অংশে স্বর্গের জাহাজ ভাসানোর উৎসব পালন করে আসছে। উৎসবটা সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির মিলনমেলায় পরিণত হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ছাড়াও আসেন হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ। তবে করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সীমিত আকারে এ উৎসব হয়েছিল।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে জাহাজ ভাসানো উৎসবের উদ্বোধন করেন কক্সবাজার-৩ (রামু-সদর) আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল। এ সময় বক্তব্য দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম, রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা প্রমুখ।

সাংসদ সাইমুম সরওয়ার বলেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় যে সম্প্রীতি ফিকে হয়েছিল, তা আবার ফিরে এসেছে। আজকের জাহাজ ভাসানোর এ অনুষ্ঠান তার প্রমাণ। জাহাজ ভাসানো উৎসবে বিপুলসংখ্যক বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিমের উপস্থিতি প্রমাণ করে, রামু এখন শান্তি ও সম্প্রীতির জায়গা।

উৎসব কর্মসূচির আয়োজন করে রামু কেন্দ্রীয় প্রবারণা ও জাহাজ ভাসা উৎসব উদ্‌যাপন কমিটি। কমিটির সভাপতি ডালিম বড়ুয়া বলেন, প্রতিবছর তিন মাস ভিক্ষুদের বর্ষাব্রত পালন শেষে প্রবারণা পূর্ণিমার পরের দিন জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়।

রামু ছাড়া দেশের কোথাও জাহাজ ভাসানো উৎসব হয় না। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করে আসছেন।

বাঁশ, বেত ও রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় এককটি ‘স্বর্গের জাহাজ’। পাঁচ-ছয়টি নৌকাকে একসঙ্গে বেঁধে তার ওপর বসানো হয় ‘জাহাজ’। জাহাজে বাঁধা মাইকে বাজে বুদ্ধকীর্তন। তারপর সেই জাহাজ ভাসানো হয় বাঁকখালী নদীতে। বাদ্যযন্ত্র ও নাচগানে জাহাজে মেতে ওঠেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে জাহাজগুলো আনা হয় নদীর তীরে। প্রথমে নদীতে ভাসানো হয় সিংহ আকৃতির একটি জাহাজ। তারপর ভাসানো হয় বৌদ্ধ প্যাগোডা, উপগুপ্ত ভাণ্ডের প্রতিকৃতি, বুদ্ধমূর্তির আদলে তৈরি পাঁচটি স্বর্গের জাহাজ। ভাসতে ভাসতে জাহাজগুলো ছুটছিল নদীর এদিক-সেদিক।

ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে যোগ দেয় উপজেলার হাইটুপি, দ্বীপ শ্রীকুল, হাজারীকুল, রাখাইনপাড়া, দক্ষিণ শ্রীকুল, পূর্ব রাজারকুল জাদিপাড়া, মেরংলোয়াসহ আশপাশের অন্তত ১৯টি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ।

উৎসবের কিছুদিন আগে থেকে ঢোল, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বুদ্ধকীর্তন গেয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা সংগ্রহ করেন শিশু-কিশোর-যুবকেরা। সেই টাকায় তৈরি হয় বিভিন্ন প্রতিকৃতির ‘স্বর্গের জাহাজ’।

উৎসব সম্পর্কে রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা এলাকায় একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসব প্রচলন হয়। রামু ছাড়া দেশের কোথাও জাহাজ ভাসানো উৎসব হয় না।

বৌদ্ধভিক্ষুরা জানান, আড়াই হাজার বছর আগে বৈশালী রাজ্যে অনাবৃষ্টি, খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর প্রভাবে মানুষ ও জীবজন্তু মারা যাচ্ছিল। তখন গৌতম বুদ্ধ বৈশালী রাজার আমন্ত্রণে শিষ্যদের নিয়ে ওই রাজ্যে যান। তিনি ‘রত্নসূত্র’ পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে বৈশালীকে রক্ষা করেন। ফিরতি পথে সর্পদেবতারা ৫০০টি নৌকায় শিষ্যসহ বুদ্ধকে নদী পার করে দেন। সেই দিনকে স্মরণ করতেই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করে আসছেন।