কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। বালুখালী-৮ ক্যাম্পের ডি ব্লকের একটি ঘরের রান্নার চুলা থেকে এ সূত্রপাত। বাতাসের গতিবেগ বেশি ছিল বলে আশপাশের তিনটি ক্যাম্পের পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ঘনবসতি হওয়ায় বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য।
গত ২২ মার্চের এ অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজার ১৬৫টি বসতি পুড়ে যায়। প্রাণ হারায় ১১ জন।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াতকে প্রধান করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে গত ২৯ মার্চ। তবে তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে আজ বুধবার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, ১৩ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। প্রথমে ধ্বংসস্তূপের ওপর গুচ্ছাকারে শরণার্থীদের ঘরগুলো তৈরি হচ্ছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ মার্চ বেলা সোয়া দুইটার দিকে সিলিন্ডার নিঃসরিত গ্যাস থেকে মৌলভি খলিলের ঘরে আগুন ধরে। এরপর সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে তা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৬২ ফুট দূরে আরেক রোহিঙ্গা ইব্রাহিমের ঘরের চালায় আঘাত হানে। নতুন গ্যাস সিলিন্ডার–সংযোগ লাগানোর সময় আগুন লেগে থাকতে পারে। পরবর্তী সময়ে আরও তিনটি শেল্টারে আগুন লাগে। আবহাওয়া উত্তপ্ত থাকায় এবং বাতাসের গতিবেগ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় উঁচু টিলা থেকে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগুনে পুড়ে যায় ১০ হাজার ১৬৫ পরিবারের বসতি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকসংখ্যা ৫০ হাজার ৮৫৯। এর মধ্যে ক্যাম্প-৮–এর ১ হাজার ৫৮৯ পরিবারের ৭ হাজার ৪৩১ জন, ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টের ২ হাজার ৫৮৯ পরিবারে ১৩ হাজার ৪৯৩ জন এবং ক্যাম্প-৯–এর ৫ হাজার ৯৮৭ পরিবারে ২৯ হাজার ৯৩৫ জন। তিনটি ক্যাম্পে ৭টি স্বাস্থ্যসেবা, ১৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ৩৪৬টি সেবা প্রদানকারী বেসরকারি সংস্থার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দোকান পুড়ে গেছে ৮০০টি।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত হয়েছে ১৫৮ জন। মারা গেছে ১১ জন। এর মধ্যে ক্যাম্প-৮ ইস্টে এক শিশু, ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টে ৫ জন, ক্যাম্প-৯–এ ৫ জন প্রাণ হারায়। মৃতদের মধ্যে চারজনের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
তদন্ত কমিটি ২৪ ও ২৫ মার্চ সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ২১ জন প্রত্যক্ষদর্শী (অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্পে কর্মরত) সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবীর সাক্ষ্য গ্রহণ ছাড়াও শতাধিক ব্যক্তির বক্তব্য শোনে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে স্থানীয় কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা এবং পুনর্বাসন ও ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনারোধে সুপারিশমালা প্রণয়ন—তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয় কমিটি।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে এবং সাব ব্লকে প্রবেশের সহজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের শেল্টার পুনর্নির্মাণ, ফাঁকা জায়গা ও পানির আধার সৃষ্টিসহ ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরে কমিটি।
সুপারিশের মধ্যে আছে, প্রতিটি শেল্টারে ঘর গুচ্ছাকারে নির্মাণ ও প্রতিটি গুচ্ছের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব এবং শেল্টার নির্মাণে অগ্নিনিরোধক উপকরণের ব্যবহার নিশ্চিত করা; দুর্যোগকালে সমবেত হওয়ার জন্য ক্যাম্পে প্রয়োজনীয় দূরত্বে উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ; রান্নার স্থানসংলগ্ন বাঁশের বেড়া মাটি অথবা সিমেন্ট বালুর প্রলেপ দ্বারা আচ্ছাদন, প্রতি শেল্টারে রান্নার একক ব্যবস্থা না রেখে চার থেকে আটটি পরিবারের জন্য একটি কমিউনিটি কিচেন চালু; অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্রুত বের হওয়ার জন্য দৃশ্যমান স্থানে জরুরি গমনপথ স্থাপন; ক্যাম্পের ভেতরে কমপক্ষে ৫০ হাজার গ্যালন ধারণ ক্ষমতার জলাধার নির্মাণ; ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য সেবা সংস্থার যানবাহন প্রবেশ উপযোগী রাস্তা নির্মাণ; বালুখালী এলাকায় একটি প্রথম শ্রেণির স্থায়ী ফায়ার স্টেশন স্থাপন; ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করা এপিবিএনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক টহল যান সরবরাহ প্রভৃতি।
উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৪ এপিবিএন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ও পুলিশ সুপার নাইমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। এ ব্যাটালিয়নের আওতায় প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গার বসতি হলেও জনবল মাত্র ৭০০ জন। পুলিশের টহল যান ও আবাসন–সংকটও মারাত্মক।