>২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়লাভ করেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই বছরের ২৬ জুলাই দায়িত্ব নেন। আজ শুক্রবার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। নির্বাচনের আগে দেওয়া ৩৫ দফা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এবং কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। গত রোববার বিকেলে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে মেয়রের এ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক একরামুল হক ও নিজস্ব প্রতিবেদক সুজন ঘোষ।
প্রথম আলো: দায়িত্ব নিয়েছেন চার বছর হলো। সার্বিক মূল্যায়ন কী?
আ জ ম নাছির উদ্দীন: এই চার বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে একটি জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমি মনে করি, নাগরিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যা করার সুযোগ ছিল বা আছে সেটি আমি যথাযথভাবে করতে পেরেছি। করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে একটি পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, সড়কবাতি, নালা–নর্দমা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে যদি বলি প্রত্যাশার তো শেষ নেই। রাতারাতি কোনো কিছু পরিবর্তন করা যায় না।
প্রথম আলো: চার বছরের দায়িত্ব পালনকালে নিজেকে ১০০ এর মধ্যে কত দেবেন?
নাছির উদ্দীন: ৯০ দেব। আমি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরি। মানুষের রেসপন্স দেখে মনে হয়, মানুষ আমার ওপর আস্থা রেখেছে। তথ্য–উপাত্ত বিবেচনা করে এবং করপোরেশনকে যে জায়গায় নিয়ে গেছ তা বিবেচনা করে নিজেকে ৯০ দেব।
প্রথম আলো: তাহলে ১০ ভাগ ঘাটতি কেন?
নাছির উদ্দীন: ঘাটতি বলব না, এটি জনগণের জন্য রেখে দিলাম।
প্রথম আলো: শত কোটি টাকা ব্যয়ের পরও নগরের সড়ক টেকসই হচ্ছে না কেন?
নাছির উদ্দীন: সড়ক টেকসইয়ের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আরসিসি রাস্তার কথা বলেছেন। কিন্তু প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদেরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। কেননা এখানে সেবা সংস্থার লাইনের জন্য আলাদা বা সুনির্দিষ্ট কোনো লেন নেই—যা উন্নত বিশ্বে আছে। নালার মধ্যে দিয়ে পাইপলাইন গেছে। আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি তো আছে। একবার রাস্তা কাটা হলে তা কোনোভাবেই পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। পানি জমে থাকার কারণে বিটুমিন সরে যায়। যখন ভারী গাড়ি চলে তখন সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়।
প্রথম আলো: যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি নেই সেখানেও সড়ক বেহাল কেন? নিম্নমানের কাজের অভিযোগ আছে?
নাছির উদ্দীন: না না। এই রকম সড়ক ভাঙছে না। নকশা অনুযায়ী ঠিকাদারেরা কাজ করেন। তবে আমাদের আর্থিক সংকট রয়েছে। তাই নিজেদের টাকায় কাজ করতে অনেক টানাহেঁচড়া করতে হয়। আমাদের রাস্তাগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে লোড টেস্ট করা হয় না। বিদেশে তা করা হয়। কী পরিমাণ ও কত ভারী যানবাহন চলাচল করে তা পরীক্ষা করে সড়ক নির্মাণ করলে এই অবস্থা হয় না। আর একটি বিষয় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আমার মেয়াদে কোনো ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করেছেন এই রকম অভিযোগ কেউ করতে পারবে না।
প্রথম আলো: সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির একটি খবর ভেসে বেড়ায়। এখন সম্পর্ক কেমন?
নাছির উদ্দীন: আমি তো সরকারের অংশ। এখানে সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন কিসের? সরকারের সঙ্গে আগেও যে সম্পর্ক ছিল এখনো তা আছে। ভবিষ্যতেও তা থাকবে। আর আমি দলের সাধারণ সম্পাদক। যদি সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন থাকত তাহলে দলের সাধারণ সম্পাদক বা মেয়র থাকার কী সুযোগ আছে? এগুলো দুষ্টু লোকের প্রচারণা। আর আমার সময়ে করপোরেশনের যতগুলো প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে তা আগের ইতিহাসে নজির নেই।
প্রথম আলো: নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কত শতাংশ পূরণ করলেন?
নাছির উদ্দীন: ক্লিন ও গ্রিন সিটি এবং নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগর গড়ার লক্ষ্য নিয়ে দায়িত্ব শুরু করি। এই শহরের কাঁচা ও ইটের তৈরি রাস্তা কমিয়ে পাকা রাস্তা করেছি। সড়কবাতি দ্বিগুণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার মান যে পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল এখন তা ওপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিক্ষার যে পরিবেশ ছিল তা এবং অবকাঠামোগত ও শিক্ষক স্বল্পতা দূর করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর হকারদের একটি সময়ের মধ্যে বসতে দেওয়া হচ্ছে। এই কাজে শতভাগ সফল হতাম, যদি অপরাজনীতি না থাকত। যখনই কঠোর হতে যাই তখনই এটি নিয়ে কোনো না কোনো অপচেষ্টা করা হয়।
প্রথম আলো: কারা করছে?
নাছির উদ্দীন: আছে। ভেতরে–বাইরে। এটি সবাই জানে। আপনারাও জানেন। আর বিলবোর্ড অপসারণে শতভাগ সফলতা দেখিয়েছি। ই–জিপি প্রথা চালু করা হয়েছে।
প্রথম আলো: জলাবদ্ধতা নিরসন প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দায় এড়াবেন কেমন করে?
নাছির উদ্দীন: এই সমস্যা নিরসনে শুরু থেকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি। যেদিন দায়িত্ব নিই সেদিন মুষলধারের বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা ডুবে যায়। তাই জলাবদ্ধতাকে প্রাধান্য দিয়ে জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) প্রকল্পের আওতায় চীনের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার চায়নার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করি। তারা ১১ মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দেয়। এর ওপর ভিত্তি করে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যা ছিল একেবারে পরিকল্পিত। এই প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন হয়ে পরিকল্পনা কমিশনে ছিল। কিন্তু এর মধ্যে সিডিএ একটি প্রকল্প নেয়—যা অনুমোদিত হয়ে এখন চলমান আছে। তাই এ ক্ষেত্রে আমার করার কিছু নেই। তবে আমি আমার প্রতিশ্রুতি পূরণে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকিনি।
প্রথম আলো: আপনার নেওয়া প্রকল্প কী সিডিএ অনুসরণ করেছে?
নাছির উদ্দীন: না। তারা কোনোটিই করেনি। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, এই প্রকল্প যাচাই–বাছাই ও সমীক্ষা না করে নেওয়া হয়েছে। এটি তো অনুমোদনের সময় বলেছেন। কিন্তু সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছিলেন, প্রথম বছরেই সুফল পাবেন। পরের বছরে ৭০–৮০ ভাগ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এই বছর আরও বেড়ে গেছে। নগরবাসীর প্রত্যাশাকে অহেতুক ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে বড় করার বিষয়ে আমার আপত্তি ছিল। অহেতুক এগুলো করা হয়েছে। সত্য ও বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। তবে নগরবাসীকে যদি আমরা ইতিবাচকভাবে ধারণা দিতাম, প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আন্তরিক এবং উনি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে। আপনাদের সহযোগিতা লাগবে। কেননা এখানে অনেক ধরনের কাজ আছে। এক–দুই বছরে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা নয়।
প্রথম আলো: জলাবদ্ধতার জন্য জনগণ আপনাকে দায়ী করছে। সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের কাছে প্রত্যাশা বেশি। আপনার মতে জলাবদ্ধতা নিরসন না হওয়ার দায় কার?
নাছির উদ্দীন: দায় কার আমি তা বলব না। সরকারের বিভিন্ন শাখা আছে। সিডিএ ও সিটি করপোরেশনও তেমন শাখা। তবে সিটি করপোরেশন জনপ্রতিনিধি দিয়ে পরিচালিত। যার কারণে করপোরেশনের কাছে জনগণের প্রত্যাশা থাকবে। আমি এটি অনুভব করি। তবে যারা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন দায়–দায়িত্ব তাঁদের। সাফল্য–ব্যর্থতাও তাঁদের। অবশ্য আমার না। প্রকল্প অনুমোদনের পর দুটি বছর চলে গেছে। এখন নতুন নতুন এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণ কারা করবে তাও নির্ধারণ করা হয়নি।
প্রথম আলো: তাহলে এখানে রাজনীতি ছিল?
নাছির উদ্দীন: থাকতে পারে ।
প্রথম আলো: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারলেন?
নাছির উদ্দীন: বাংলাদেশের বাস্তবতায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, নগরে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদের অনেকের মধ্যে নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো বোধ নেই। ডাস্টবিন দেওয়া হলেও নির্ধারিত জায়গায় ময়লা ফেলে না লোকজন। তারপরও আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর জোর গলায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারব, আগে কেউ যদি বিমানবন্দর থেকে মূল শহরে আসতেন তাহলে রাস্তার দুই পাশে অনেকগুলো ময়লার কনটেইনারে ময়লা উপচে পড়ে থাকত। দুর্গন্ধ ছড়াত। এখন সে চিত্র নেই। ডাস্টবিনগুলো রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ডোর টু ডোর নামে নতুন ধারণা চালু করেছি। এখন রাতে ময়লা অপসারণ করা হয়।
প্রথম আলো: কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট নন। অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন একবার।
নাছির উদ্দীন: এটা করতে হবে। কেন না আমার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে শতভাগ। তা অর্জন করতে পারিনি। এখানে শতভাগ সফল হতে হবে। আমাদের আরেকটি চ্যালেঞ্জ, নগরে অনেকগুলো মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। সবগুলোর জন্য রাস্তা কাটাকাটি হচ্ছে। এতে ধুলাবালু উড়ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হলে শহরকে আরও ক্লিন ও পরিচ্ছন্ন রাখা যেত।
প্রথম আলো: সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের জন্য একসময় নগর সরকারের দাবি তুলেছিলেন সাবেক মেয়ররা? আপনার কী মত?
নাছির উদ্দীন: রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও একটা বিষয়ে মেয়ররা একমত, এখানে সবাইকে একটি ‘আমব্রেলার (ছাতা)’ নিচে আসতে হবে।
প্রথম আলো: অর্থাৎ নগর সরকার দরকার?
নাছির উদ্দীন: আমি নগর সরকার বলব না। বলব আমাদের একটি ছাতার নিচে আসতে হবে। যে নামেই বা আঙ্গিকে হোক, মেয়রকে অথরিটি দিতে হবে। কারণ মেয়রের ওপর যেহেতু নগরবাসীর প্রত্যাশা বেশি। ভুল হোক বা ঠিক হোক—ভালো–মন্দের জন্য মেয়রকে দায়ী করা হয়।
সেখানে মেয়রকে যদি অথরিটি না দেওয়া হয়, মেয়রের যদি ক্ষমতা বা এখতিয়ার না থাকে তাহলে কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন? যানজট, বিদ্যুৎসহ যেকোনো সমস্যার জন্য মেয়রকে দায়ী করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মেয়রের কিছু করার নেই।
প্রথম আলো: সমন্বয়ের জন্য আপনার প্রস্তাব কী সরকারকে বলেছেন?
নাছির উদ্দীন: অবশ্যই বিভিন্ন সময়ে বলেছি। ভবিষ্যতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে গেলে এই সমন্বয়ের বিষয়টি চলে আসবে। উন্নত বিশ্বে যাঁরা মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তাদের অধীনে থাকে সব সংস্থা। এমনকি পুলিশও। আর এখানে করপোরেশন বিভিন্ন সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। ফলে যে গতিতে কাজ করার কথা সে গতি করা হয় না।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নাছির উদ্দীন: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।