রাজশাহীতে আশঙ্কাজনক হারে জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। বিপরীতে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের ভবন। গত ৫৯ বছরে রাজশাহীর জলাশয়ের প্রায় ৯৭ দশমিক ১৬ শতাংশ দখল ও ভরাট হয়েছে। ৯৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী শহরে এখন জলাশয় আছে মাত্র ১২০টি। যার মধ্যে কেবল ২২টি পুকুর সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এমন অবস্থায় আজ রোববার সারা বিশ্বের মতো দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব জলাভূমি দিবস। এবারের স্লোগান—জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর রামসার সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাভূমি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন সংরক্ষণ করে। রক্ষা করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
রাজশাহীর পরিবেশসচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় এমনিতেও রাজশাহীতে পানির স্তর নিচের দিকে থাকে। এর মধ্যে ভূমির উপরিভাগের জলাশয়গুলো যেভাবে ভরাট হচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। রাজশাহীতে শীতের সময় তীব্র শীত আর গরমের সময় তীব্র গরমের যে আবহাওয়া বিরাজ করে, তা পরিমাণমতো জলাভূমি না থাকার কারণেই।
রাজশাহীর পুকুর, জলাশয় নিয়ে গবেষণা করে হেরিটেজ রাজশাহী নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহী শহরে সবচেয়ে বেশি জলাশয় ছিল ১৯৬০ সালে। তখন সংখ্যাটি ছিল প্রায় ৪ হাজার ২৩৮। ১৯৮১ সালের এক জরিপে জলাশয়ের সংখ্যা পাওয়া যায় ২ হাজার ৭১। ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যায়, রাজশাহীতে ১২ কাঠা বা তার বেশি আয়তনের জলাশয় আছে ১২০টি। অর্থাৎ প্রতি ১০ বছরে রাজশাহী জেলায় জলাশয়ের সংখ্যা কমেছে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ হারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী তন্ময় সান্যাল বলেন, আইনের বিধান অনুযায়ী পৌর অথবা সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো জলাধারের আকার পরিবর্তন করতে পারবে না। অথচ রাজশাহীতে নির্বিচারে জলাধার ভরাট চলেছে। এখন তাই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। যে কয়টি জলাশয় আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় হয়তো কোথাও আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যাবে না।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ১২০টি পুকুরের মধ্যে কর্তৃপক্ষ মাত্র ২২টি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা শুধু দুই একরের বেশি আয়তনের ২২টি পুকুর সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন অন্য পুকুরগুলোর ব্যাপারে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই।
অথচ একসময় রাজশাহীতে থাকা বিপুলসংখ্যক জলাশয় তৈরি করেছিলেন তখনকার নগর কর্তৃপক্ষ বা শাসকেরাই। হেরিটেজ রাজশাহী সূত্রে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মারাঠা দস্যুদের (বর্গি) হামলার আশঙ্কায় রাজধানী মুর্শিদাবাদ ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার হাজার হাজার মানুষ এই শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। সেই সময় মিঠাপানির উৎসের প্রয়োজনে রাজশাহীতে বহু দিঘি, পুকুর ও নয়নজুলি খনন করা হয়। আরেক দফা ১৮২৫ সালে নাটোর থেকে রাজশাহী জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র রামপুর-বোয়ালিয়ায় (বর্তমান রাজশাহী) স্থানান্তরিত হলে রাজশাহী অঞ্চলের রাজা ও জমিদারেরা শহরে বসবাসের জন্য নিজেদের বসতবাড়ি, কাচারিবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। এ সময় তাঁরা নিজেদের ও এলাকাবাসীর প্রয়োজনে শত শত পুকুর ও দিঘি খনন করতে থাকেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীও জলাশয় খননে এগিয়ে আসেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাতিডোবা, মঠপুকুর, ছয়ঘটি, মেহেরচণ্ডী দিঘি, রানীপুকুর ইত্যাদি। অবশ্য এর আগেই নীলকর সাহেবরা শহরে বেশ কিছু পুকুর খনন করে। এর মধ্যে বড়কুঠি পুকুর, কাজলা দিঘি ও শিরোইল রেশম কুঠির দিঘি উল্লেখযোগ্য। রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে সোনাদিঘি খনন করা হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। একসময় সোনাদিঘির পানি দিয়ে রান্নার কাজ চলত। সে সময় পৌরসভার নিয়মিত পাহারাদার থাকতেন। তাঁরা কাউকে পানিতে নামতে দিতেন না।
রাজশাহী শহরে একসময় পুকুর খননের যেমন উৎসব শুরু হয়েছিল, তেমনি পুকুর ভরাটেরও মহোৎসব শুরু হয়। ১৯২৯ সালের দিকে মহাকাল দিঘি ভরাট করে রাজশাহী কলেজের মাঠ তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপরে দেবালয়, দেওরাজার বাড়ি ও এই মহাকাল দিঘি। বর্তমান রাজশাহী বাস টার্মিনালের জায়গায় ছিল প্রায় দুই একর আয়তনের একটি বিশাল পুকুর। এটির নাম ছিল হাতিডোবা। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শিরোইল বাস টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুকুরটি ভরাট করে।
রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান জানান, একসময় রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) একটি প্রচারপত্র বিলি করেছিল। এই প্রচারপত্রে বলা হয়, শহরের কেউ পুকুর ভরাট করতে চাইলে অনুমতি লাগবে। কেউ অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের বিষয়ে টেলিফোনে অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এখন আরডিএকে সরাসরি গিয়ে জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
এ বিষয়ে আরডিএর চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ভেতরের পুকুরের ব্যাপারে তাঁরা দেখবেন। কেউ পুকুর ভরাট করে সেখানে ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এলে, তার অনুমোদন দেওয়া হবে না।