রাজশাহী শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার রাতে জরুরি বিভাগে
রাজশাহী শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার রাতে জরুরি বিভাগে

কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ, ১২ মেডিকেল শিক্ষার্থী হাসপাতালে

রাজশাহীতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের ওপরে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ শুক্রবার বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১২ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নগরের চন্দ্রিমা থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

আহত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রীদের হাসপাতালের ১ নম্বর ওয়ার্ডে ও ছাত্রদের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা-২০১১ (সংশোধিত) প্রতিপালন না করায় রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজে ২০২০-২০২১ শিক্ষা বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২ নভেম্বর স্বাক্ষরিত মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত এক চিঠিতে এই মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানানো হয়। ওই চিঠি ৬ নভেম্বর মেডিকেল কলেজে এসে পৌঁছায়। চিঠিতে কলেজে শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মাইগ্রেশন (স্থানান্তর) করার ব্যবস্থা করার জন্য মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে।  আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারি এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান

৮ নভেম্বর এক সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতারিত হয়েছেন। তাঁদের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়েছিল। সার্টিফিকেট বিক্রির কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে যেন আর না গড়ে ওঠে। প্রতারণার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

রাজশাহী শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার রাতে জরুরি বিভাগে

ওই দিনই কলেজটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাল্টা সমাবেশ করে বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। কর্তৃপক্ষও তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে বলে, কলেজ বন্ধ হয়ে গেলে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারাবেন। তাই যেন কলেজটি চালু রাখার ব্যবস্থা করে সরকার।

আজ হামলার শিকার হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা জানান, আগামীকাল শনিবার মন্ত্রণালয় থেকে কলেজ পরিদর্শনের কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে কলেজে কী হচ্ছে, তা খোঁজ নিতে তাঁরা কলেজে এসেছিলেন। আর কিছু ছাত্রী তাঁদের জামাকাপড় নিতে হোস্টেলে ঢুকেছিলেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামানসহ কর্মচারীরা বাঁশ ও লোহার রড দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়ে আহত করেন। হামলাকারীরা ছাত্রীদের শ্লীলতাহানিও করেছেন। তাঁদের মারধরে ছাত্রীদের জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে। ছবি তুলতে গেলে তাঁদের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে। মারধর করে তাঁদের মেডিকেল কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে তাঁরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ট্রলিতে করে একজন ছাত্রকে ভেতরে নেওয়া হচ্ছে। তাঁর পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পায়ে জখম হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে ধারণ করা ৩১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মারধরের সময় চিৎকার করে ছাত্রীরা ছোটাছুটি করছেন। একই ভিডিওতে দেখা যায়, লাঠি দিয়ে এক ব্যক্তি ছাত্রীদের বেধড়ক পেটাচ্ছেন।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে নগরের চন্দ্রিমা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ব্রজগোপাল প্রথম আলোকে জানান, ঘটনার খবর শুনে তাঁরা পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়, তখন শিক্ষার্থীরা চলে গেছেন। তিনি বলেন, ছাত্রীরা তাঁদের হোস্টেলে জামাকাপড় নিতে এসেছিলেন। তিনি শুনেছেন এটা নিয়ে সেখানে একটা গন্ডগোল হয়েছে। এ ব্যাপারে দুজন শিক্ষার্থী থানায় অভিযোগ করতে এসেছেন। তাঁদের অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন হবে। সেই জন্য তিনি অধ্যক্ষের কার্যালয়ে বসে কাগজপত্র ঠিক করছিলেন। এমন সময় বাইরে হইচই শুনে তিনি এগিয়ে যান। তিনি দেখেন কিছু শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কর্মচারীরা তাঁদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের ধাক্কাধাক্কি হয়েছে। তিনি পুলিশে খবর দিলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের বের করে দেন।

শুরু থেকেই ছিল অভিযোগ

২০১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শর্ত সাপেক্ষে ১২টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজও ছিল। রাজশাহী নগরের খড়খড়ি এলাকায় অবস্থিত এই মেডিকেল কলেজের উদ্যোক্তা ও চেয়ারম্যান সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে নিয়মনীতিকে পাশ কাটিয়ে ও তড়িঘড়ি করে এক দিনে ১২টি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।

জানা গেছে, কলেজে প্রথম ব্যাচে ১৮ জন ও দ্বিতীয় ব্যাচে ২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তৃতীয় ব্যাচে কলেজ কর্তৃপক্ষ আসনসংখ্যা বৃদ্ধির আবেদন জানায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিদর্শন শেষে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমোদন দেয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়। এ ঘটনায় ২০১৬ সালে ওই বর্ষের কার্যক্রম স্থগিত করে কলেজ কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় ওই শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম স্থগিতই রাখা হয়।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সাতটি ব্যাচে প্রায় ২২৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করায় কলেজটি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন পায়নি। এতে এমবিবিএস পাস করা চারজন শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ করতে না পেরে এক বছর বসে ছিলেন। এ অবস্থায় কলেজ কর্তৃপক্ষকে দেওয়া তিন দিনের আল্টিমেটাম শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা থেকে শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমবেত হয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তাঁরা তাঁদের ১৭ দফা দাবিসংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড পরিদর্শন করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না বলেও ঘোষণা দেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন।

আন্দোলনের মুখে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কর্তৃপক্ষ কলেজটি বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের ওই দিন রাত ৮টা এবং ছাত্রীদের পরদিন সকাল ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা তখন জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদন না থাকায় এই কলেজের শিক্ষার্থীরা এমবিবিএস পাস করার পরেও ইন্টার্নশিপ করতে পারছেন না। আবার কলেজে হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগী না থাকায় প্র্যাকটিসও করতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া নানা অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত কলেজটিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে এক সপ্তাহ ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন তাঁরা। অনুমোদন না থাকার পরও সাত বছর ধরে অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলেন প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে।

শিক্ষার্থীরা আরও জানান, কলেজের প্রথম ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলেন ১৮ জন। কিন্তু নীতিগত অনুমোদন ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক এবং প্র্যাকটিক্যাল সরঞ্জাম না থাকায় ১৪ জন শিক্ষার্থীই কলেজ ছেড়ে চলে যান। কিন্তু যাঁরা এমবিবিএস কোর্স শেষ করেছেন, তাঁরা পড়েছেন বিপদে। বিএমডিসির অনুমোদন না থাকায় তাঁরা পাস করেও ইন্টার্নশিপ করতে পারছেন না। ফলে তাঁরা এমবিবিএস পাস করেও চিকিৎসা পেশায় যেতে পারছেন না।