শুক্রবার বেলা ১১টা! নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী ফাইমা বেগম একটি নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে কাগজপত্র সই করছেন। সেখানে স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কেউই নেই। আছেন সাধারণ ভোটার। এই প্রার্থী এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে রাজশাহীর একমাত্র নারী প্রার্থী। নেতারা না থাকার ব্যাপারে এই প্রার্থী বলেন, ইউনিয়নের সভাপতিই তাঁর নির্বাচনে নামেননি। তিনি রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে। তাই ওয়ার্ড পর্যায়ের সব নেতা তাঁর পাশে নেই।
ফাইমা বেগম রাজশাহীতে ইউপি নির্বাচনের একমাত্র নারী প্রার্থী। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। তাঁকে জেলার পবা উপজেলার পারিলা ইউপির চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর আগের নির্বাচনেও তাঁকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তখনো একই ঘটনা ঘটেছিল। দলীয় নেতারা সবাই তাঁর পক্ষে ছিলেন না। ওই নির্বাচনে তিনি বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে হেরে যান।
তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর পারিলা ইউপির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবারও দলের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। গতবারের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল বারী ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সমর্থক আবু সাঈদ মোরশেদ (দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে) দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলীয় নেতারা অনেকে নৌকার পক্ষে কাজ না করে ভাগাভাগি হয়ে বিদ্রোহী দুজনের পক্ষাবলম্বন করেছেন।
শুক্রবার ওই নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে রামচন্দ্রপুরহাটে ফাইমা বেগমকে পাওয়া যায়। তিনি রামচন্দ্রপুর ওয়ার্ড কার্যালয়ে বসে নির্বাচনী কিছু কাগজপত্র সই করছিলেন। এ সময় তাঁর পাশে শুধু তাঁর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহদপ্তর সম্পাদক নজরুল ইসলাম ছিলেন। আর স্থানীয় কিছু কর্মী ছিলেন।
নজরুল ইসলাম অবশ্য বলেন, নেতারা প্রার্থীর সঙ্গে নেই এটা ঠিক নয়। ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে কোনো নেতা না থাকতে পারেন। এটা দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়। মাঠে অন্য নেতা-কর্মীরা সবাই আছেন। তাঁরা মাঠে নৌকা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।
ফাইমা বেগম অবশ্য খোলাখুলি বলে দিলেন, তাঁর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব আলী খোদ পারিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যালয়কে বিদ্রোহী প্রার্থী মো. সাঈদ আলী ওরফে মোরশেদের কার্যালয় বানিয়ে তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। দলের নেতারা তাঁদের নেতাদের নির্দেশনা মেনে নির্বাচন করছেন। তিনি পারিলা বাজারে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে আসার জন্য অনুরোধ জানান।
তাঁর কথামতো সেখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পারিলা বাজারে গিয়ে সোহরাব আলীকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো কার্যালয় নেই। কিন্তু স্থানীয় লোকজন বাজারের ভেতরে আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি দেখিয়ে দিলেন। সেই কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত একটি পোস্টার রয়েছে। নৌকার কোনো পোস্টার নেই। বরং বাইরের দেয়ালে বিদ্রোহী প্রার্থী আবু সাঈদের পোস্টার রয়েছে। সেখানে মঞ্জুর রহমান নামের একজন কর্মী বসে ছিলেন। দলীয় কার্যালয়ে নৌকার পোস্টার নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনী কার্যালয়ে নৌকার পোস্টার রয়েছে। এটা দলীয় কার্যালয়। এখানে শুধু একজন মেম্বারের পোস্টার রয়েছে। কেন চেয়ারম্যানের পোস্টার নেই প্রশ্নে তিনি কোনো জবাব দেন না।
এই কার্যালয়ের পাশেই বিদ্রোহী প্রার্থী আবু সাঈদের কার্যালয় করা হয়েছে। সেখানে অনেকগুলো চেয়ার রাখা আছে। আবু সাঈদের বিরাট একটি ব্যানার টানানো রয়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপরে এসে দেখা যায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহরাব আলী বিদ্রোহী প্রার্থী আবু সাঈদের নির্বাচনের পোলিং এজেন্টেদের ফরম বিতরণ করছেন। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে চাননি। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর অবস্থান নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, মাঠের লোকজন রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। এ কথা বলেই তিনি মোটরসাইকেলে উঠে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করেন।
পবার ললিতাহার বাইপাস মোড়ের শাওন নামের এক চা-দোকানি বলেন, পারিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এলাকা এটা সবাই জানে। কিন্তু দল থেকে তিনজন প্রার্থী হওয়ার কারণে ভোট তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে।
ইউনিয়নের কিস্টগঞ্জ বাইপাস মোড়ে চায়ের দোকানে কথা বলার সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজশাহী সুগার মিলের একজন কর্মচারী বলেন, নৌকার প্রার্থী ফাইমা বেগমের সঙ্গে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আসলে নেই। তাঁর মেয়েজামাই কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী এসে নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দিয়ে এ কদিন মাঠ গরম করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মন্তব্য করার ঘটনায় তাঁর নামে মামলা হয়েছে। তিনি আর শাশুড়ির নির্বাচনী সভায় আসতে পারছেন না। এই জন্য তাঁর মাঠের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে।
জামাতা আব্বাস আলীর না আসার কারণে তাঁর মাঠের অবস্থা খারাপ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ফাইমা বেগম বলেন, জামাইয়ের নির্বাচনী এলাকা আলাদা। তাঁর নির্বাচনী এলাকা আলাদা। তার কী হলো, না হলো তার সঙ্গে এই নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। যাঁরা মাঠে তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তাঁরাই আছেন। তিনি বলেন, যে নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে তাঁরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারতেন না।