মুঠোফোনে মাছচাষি রিন্টু আলী কোনো কথা পরিষ্কার করে বলতে পারছিলেন না। কান্নায় তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। তাঁর চারটি পুকুরের সব মাছ এক দিনে মরে ভেসে উঠেছে। তাঁর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া এলাকায়। রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তার হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বুধবার এক দিনেই জেলায় ৬১৬ মেট্রিক টন মাছ মরে ভেসে উঠেছে, যার আনুমানিক মূল্য ১২ কোটি টাকা। মৎস্য বিভাগ বলছে, হঠাৎ করেই পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে এ অবস্থা হয়েছে। গত ২০-৩০ বছরে চাষিরা এই অবস্থা দেখেননি।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, জেলার ৪ হাজার ৯৩০ জন চাষির মাছের ক্ষতি হয়েছে। এই মাছের আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল ১১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। গত মঙ্গলবার সারা দিন আবহাওয়া গুমোট ছিল। পরেই আবার বৃষ্টি হয়। এসব কারণে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যেসব পুকুরে অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য ‘অ্যারেটর’ যন্ত্র রয়েছে, সেসব পুকুরে মাছের ক্ষতি হয়নি। বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলার পবা উপজেলার চাষিদের।
পবা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, পবায় ৩০৭ মেট্রিক টন মাছের ক্ষতি হয়েছে। এ মাছের আনুমানিক মূল্য ৭ কোটি টাকা। ২০-৩০ বছর ধরে যেসব চাষি মাছ চাষ করছেন তাঁরা বলছেন, এ রকম অবস্থা তাঁরা কখনো দেখেননি।
মোহনপুরের চাষি মোজাম্মেল হক বলেন, তাঁর মোহনপুরে পাঁচটি ও বাগমারায় চারটি পুকুর রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মোহনপুরে তাঁর একটি পুকুরের পাহারাদার খবর পাঠান পুকুরে মাছ লাফালাফি করছে। তিনি পুকুরপাড়ে ছুটে গিয়ে দেখেন, পুকুরে মাছ তোলপাড় করছে। রাত তিনটা পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। তাঁর জ্ঞান ছিল না। লোকজন তাঁকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। ভোর চারটার দিকে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার পুকুরে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, পুকুরের পানি দেখা যাচ্ছে না। শুধু মাছ ভেসে সাদা হয়ে আছে। তাঁর ৯টি পুকুরের একই অবস্থা হয়েছে। তিনি কিছুই করতে পারেননি। বাসায় ১০ কেজি অক্সিজেন ট্যাবলেট ছিল। পুকুরে দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
মোজাম্মেল হক বলেন, তাঁর পুকুরের মাছ কী হয়েছে, তিনি ভালো করে বলতে পারবেন না। যে যা পারে নিয়ে গেছে। মোহনপুরের কেশরহাট বাজারে পাঠানো হয়েছিল। ৪০০ টাকা কেজির মাছ ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়েছে। গতকাল বিকেলে এক গাড়ি (ভটভটি) মাছ বাজার থেকে ফেরত এসেছে। বিক্রি হয়নি। কেনার কোনো মানুষ পাওয়া যায়নি। সেই মাছ গ্রামের মানুষকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পবা উপজেলার পারিলা গ্রামের মাছচাষি আসাদুল্লাহ গালিব বলেন, তাঁর ১০ বিঘার একটি পুকুর আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ মরে ভেসে ওঠার খবর পেয়ে তিনি সারা রাত পুকুরে অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য ওষুধ দেওয়াসহ নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। তারপরও তাঁর প্রায় এক মণ মাছ মারা গেছে।
পবা উপজেলার মাহেন্দ্রা গ্রামের চাষি ইব্রাহিমের ১০টি পুকুর রয়েছে। তার ৭টি পুকুরের প্রায় ৬০ মণ মাছ মারা গেছে। তিনি চেষ্টা করেও মাছ বাঁচাতে পারেননি বলে জানান। আবার সেই মাছ বাজারে নিয়ে বিক্রিও করতে পারেননি। সব পানির দামে দিতে হয়েছে।
রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা বলেন, যেসব পুকুরে কাতল ও সিলভার কার্প জাতীয় মাছ বেশি চাষ করা হয়েছে, সেই সব পুকুরের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কারণ, এই দুই জাতের মাছ পানির ওপরের স্তরের খাবার খায়। এই স্তরে উদ্ভিদ প্লংটন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন তৈরি করে। এই দুই জাতের মাছ উদ্ভিদ প্লাংটন খেয়ে ফেলে। এতে অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, সেই সঙ্গে আবহাওয়ার কারণে অক্সিজেন কমে এসেছিল। যেসব চাষি নিয়মিত পুকুরে জাল টানেন এবং যাঁরা অক্সিজেন বাড়ানোর জন্য অ্যারেটর যন্ত্র ব্যবহার করেছেন, তাঁদের ক্ষতি কম হয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক এম মঞ্জুরুল আলম বলেন, পানিতে অক্সিজেনের প্রধান উৎস হচ্ছে সূর্যের আলো। সূর্যের আলোর সাহায্যে পানির উদ্ভিদ প্লাংটন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পানিতে অক্সিজেন তৈরি করে। গুমোট আবহাওয়ায় সূর্যের আলো না পেলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এমন হলে মাছ মারা যায়। এই পরিস্থিতিতে পানিতে সাঁতার কেটে বা প্যাডেল হুইলার ব্যবহার করে বাতাসের অক্সিজেন পানিতে মিশিয়ে দিতে হয়। তাতে মাছের অক্সিজেন পেতে সুবিধা হয়।