টানা তিন বছর রসুনের ফলন ভালো হলেও ন্যায্য দাম পাননি কৃষক। ফলে রসুন চাষে আগ্রহ কমেছে কৃষকের।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার কাচিনীয়া বাজারে গত বুধবার তিন মণ রসুন বিক্রি করেন রামপ্রসাদ চন্দ্র রায় (৪৫)। প্রতি মণ রসুন পাইকারিতে ৩২০ টাকা মণ হিসাবে হাতে পেয়েছেন ৯৬০ টাকা। প্রতি কেজি রসুনের দাম পড়ে ৮ টাকা। বিক্রি শেষে বস্তাগুলো সাইকেল ক্যারিয়ারে বাঁধতে বাঁধতে আফসোস করে বলেন, এর চাইতে ভুট্টা আবাদ করলে ভালো ছিল তাঁর। বাজারে এখন ভুট্টা প্রতি কেজি ২৮ টাকা করে।
রামপ্রসাদ চন্দ্র রায় বলেন, ‘এইবার কাটামারির শুরু থাকি পাঁচ টাকা, সাত টাকা, আট টাকা রসুনের বাজার। এত কষ্টে আবাদ করিয়া এই দামে রসুন বিক্রি করি পোষায়? বিচনের পাইসায় উঠে না। তার ওপর যে সারের দাম। হাল তো আছেই, নিজের খাটাখাটনিগিলা ফাও। হ্যারোট্যারো, মানুষটানুস, কামাইল কিষান দিয়া রসুন আবাদ করি ধান বেচেয়া আবাদের খরচ শোধ করির নাগোছে। রসুন আবাদ করার আক্কেল হই গেইসে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কার্তিকের শেষ ভাগ থেকে অগ্রহায়ণের শেষ পর্যন্ত রসুন লাগানোর সময়। উত্তোলন শুরু হয় চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে। রসুন উৎপাদনকারী উপজেলা হিসেবে নামডাক আছে খানসামা উপজেলার। জেলায় উৎপাদিত রসুনের প্রায় ৪০ শতাংশই আবাদ হয় এ উপজেলায়। আর জেলার সবচেয়ে বড় রসুনের হাট কাচিনীয়াতে বসে প্রতি মঙ্গল ও বুধবারে। তবে টানা তিন বছর রসুনের ফলন ভালো হলেও ন্যায্য দাম পাননি কৃষক। দাম না পাওয়ায় রসুন চাষে আগ্রহ কমেছে কৃষকের। ঝুঁকেছেন ধান ও ভুট্টা আবাদে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার ৪ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে রসুনের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। যেখানে গত মৌসুমে জেলায় রসুনের আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ৮৩ হেক্টর জমিতে। আর উৎপাদন ছিল ৪১ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। জমির পরিমাণ কমলেও কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা হওয়ায় ফলন বেড়েছে।
গত বুধবার সকালে কাচিনীয়া বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি মণ রসুন আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৫ থেকে ২২ টাকা দরে। লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, বদরগঞ্জ, নীলফামারী থেকে ব্যাপারীরা রসুন কিনতে এসেছেন। ভোর থেকে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। রাস্তার দুই পাশে বস্তা ও ব্যাগে রসুন নিয়ে আসছেন কৃষক। চলছে দরদাম। ব্যাপারীরা মাল কিনে স্তূপ করছেন ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে।
কৃষক রামপ্রসাদ বলেন, এক বিঘা জমিতে ছয়বার চাষ দিতে লাগে ৩ হাজার টাকা। বীজ কিনতে খরচ ৯ হাজার টাকা (এক বিঘায় ৬ মণ বীজ হিসাবে), সার ১০ হাজার। কীটনাশক, মজুরিসহ মোট খরচ পড়ে ৪৭ হাজার টাকা। বিপরীতে এক বিঘায় রসুন পেয়েছেন ৫৫ মণ। সবচেয়ে ছোট আকৃতির তিন মণ বিক্রি করেন ৯৬০ টাকা। অবশিষ্ট রসুন ১৮-২০ টাকা দরে বিক্রি হলেও বিঘায় লোকসান হবে সাড়ে চার হাজার টাকা।
কৃষক ধীরেন কুমার রায় বলেন, এখন থেকে তিন বছর আগেও রসুন বিক্রি করতে এসে এমন হিসাব কষতে হয়নি তাঁদের। ২০১৯ সালে এই বাজারেই রসুন বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি ৬০ টাকা দরে। তাঁর মতো অনেকেই রসুনের দাম বাড়ার আশা নিয়ে এখনো হাল ছাড়েননি।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতি মৌসুমে এ হাটে আসেন রংপুরের বদরগঞ্জের সফিউল্লাহ। তিনি বলেন, এই বাজারে ৬৫-৭০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে পাইকারিতে রসুন কিনেছেন। গেল তিন বছর থেকে বাজার মন্দা। রসুন শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু কৃষকের হাতে টাকা থাকে না। এক ফসল বিক্রি করে অন্য ফসল আবাদের খরচ জোগাতে হয়। তাই একই সময়ে বাজারে অনেক রসুন এসে যাওয়ায় দাম পড়ে যায়। আর রসুনের মৌসুমে আমদানি বন্ধ হলে স্থানীয় বাজারে কৃষকেরা কিছুটা দাম পাবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) খালেদুর রহমান বলেন, কয়েক বছর ধরে সঠিক দাম না পাওয়ায় কৃষকেরা রসুন উৎপাদন করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। তাই কৃষকদের রসুন সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।