অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন

যে ৫ কারণে চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা

টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় চট্টগ্রাম সিটির বারইপাড়া এলাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

খাল ও নালা–নর্দমা থেকে নিয়মিত মাটি উত্তোলন না করাসহ পাঁচ কারণে এবারের বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি এসব সমস্যা চিহ্নিত করেছে। তবে কমিটির চিহ্নিত করা সমস্যাগুলোর মধ্যে নতুন কিছু নেই। যেসব কারণের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দেয়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

গত ১৬ থেকে ২০ জুন টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা ডুবে যায়। অনেক জায়গায় পানি জমে থাকে ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকায় চারটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকার পরেও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

গত ২২ জুন অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সিডিএ–এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা সমাধানে ৬টি স্বল্পমেয়াদি ও ১১টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছে কমিটি। এ ছাড়া চট্টগাম নগরের ৩২টি খালে কী কী সমস্যা রয়েছে তার পরিদর্শন প্রতিবেদনও একসঙ্গে জমা দেওয়া হয়েছে।

কারণগুলো

চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতার জন্য কমিটির চিহ্নিত করা ৫ কারণ হল অতিবর্ষণ ও একইসঙ্গে কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার, খালের সংস্কার কাজের চলমান অংশে মাটি থাকার ফলে খাল সংকোচন, নগরের খাল ও নালা–নর্দমা বেদখল, নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে খাল-নালায় বর্জ্য ফেলা এবং নিয়মিত খাল-নালা থেকে মাটি উত্তোলন না করা।

অনুসন্ধান কমিটির সদস্যরা চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা বেশি হয় এমন এলাকাকে তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হল বাকলিয়া অঞ্চল, হালিশহর অঞ্চল ও চান্দগাঁও–মোহরা–আলকরণ অঞ্চল। এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের ২০টি ওয়ার্ড রয়েছে। নগরে মোট ওয়ার্ড ৪১টি। কমিটির সদস্যরা তিনটি অঞ্চলের ৩২টি খাল পরিদর্শন করেছেন।

অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষায় যাতে নগরবাসীকে আর দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, এ জন্য যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলো ইতিমধ্যে সমাধান করা হয়েছে। বাকি কাজ দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠানো হবে।

কমিটির সুপারিশসমূহ

কমিটির দেওয়া স্বল্পমেয়াদি ৬টি সুপারিশের মধ্যে রয়েছে স্ব স্ব সংস্থার উদ্যোগে চিহ্নিত সমস্যা দ্রুত সমাধান, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় বর্ষা মৌসুমে নিয়মিতভাবে খাল-নালার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চালু রাখা, পানি চলাচলে বাধা হয়ে দাঁড়ানো বিভিন্ন সেবা সংস্থার পাইপ অপসারণ, খাল-নালায় বর্জ্য না ফেলার জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো, খাল-নালা দখলকারীদের উচ্ছেদ ও তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতার বাইরের খাল-নালাগুলো সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নিয়মিত পরিষ্কার করা।

চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেক দিন ধরে সমাধান হচ্ছে না

আর দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প ও বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা, সংস্কার কাজের জন্য খালে দেওয়া বাঁধ অপসারণ, জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিলট্র্যাপ স্থাপন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সার্কেল গঠন করা, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খাল নিয়ে দ্রুত প্রকল্প হাতে নেওয়া, শেখ মুজিব কালভার্টের মাটি উত্তোলন, ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনার সুপারিশ অনুযায়ী নগরে জলাধার তৈরি করা, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ৪০টি জলকপাট পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তিনটি জলকপাটের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাট্টলী ও হালিশহর এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে মনে করছে কমিটি। তাই সেখানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খাল খনন বা বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা যেতে পারে।

জলাবদ্ধতা অনুসন্ধান কমিটির আহবায়ক সিডিএ–এর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, বাকলিয়া এলাকায় পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এ রকম যেসব সমস্যা পাওয়া গেছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তা সমাধানে কী করতে হবে ও কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে তাও বলা হয়েছে। এখন সংস্থাগুলো যদি নিজেদের কাজ করে তাহলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে নতুন কিছু নেই

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরে কী কারণে জলাবদ্ধতা হয় তা কারও অজানা নয়। এবারও ঘুরেফিরে সে কারণগুলো ওঠে এসেছে কমিটির প্রতিবেদনে। তবে কারণ অনুসন্ধান করে বসে থাকলে হবে না। পানি যাতে দ্রুত নামতে পারে সে জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব অবহেলার কারণে প্রতি বর্ষা মৌসুমেই মানুষকে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সেবা সংস্থাগুলোকে নগরবাসীর দুর্ভোগ নিরসনে আন্তরিক হতে হবে।