ভাষাটির নাম ‘রেংমিটচ্য’। বর্তমানে এ ভাষা জানা ছয়জন লোক বেঁচে আছেন। এর মধ্যে একজন নারী ও পাঁচজন পুরুষ। ছয়জনের মধ্যে চারজনের বয়স ৬০–এর বেশি। তাঁদের মৃত্যু হলে রেংমিটচ্য নামের ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবে। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও একটি সংস্কৃতি।
জানা গেল, রেংমিটচ্য ভাষা জানা ছয়জনের মধ্যে চারজন আলীকদম ও দুজন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম ম্রো জনগোষ্ঠীর পাড়ায় বসবাস করেন। আলীকদমের ৬৯ বছরের নারী কুনরাও, ৭৫ বছরের মাংপুন ও ৪৫ বছরের সিংরা ক্রাংসিপাড়ায় এবং ৫৮ বছরের থোয়াইংলক মেনসিংপাড়ায় থাকেন। ৭২ বছরের রেংপুন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবতপাড়ায় ও ৬০ বছরের মাংওয়াই একই উপজেলায় কাইংওয়াইপাড়ায় বসবাস করছেন। তাঁরা সবাই দরিদ্র জুমচাষি এবং তাঁদের বসবাসের পাড়াগুলো যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দুর্গম পাহাড়ে। এ জন্য তাঁরা রেংমিটচ্য ভাষা জানলেও তাঁদের একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ ও পরিবেশ নেই। ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ায় সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলেন এবং নিজেদের ম্রো হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন।
রেংমিটচ্য ভাষা জানা মাংপুন ও রেংপুনের সঙ্গে ভাষা হারানো, তাঁদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে এ প্রতিবেদকের একাধিকবার কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, গত শতকের ’৫০ ও ’৬০–এর দশকে আলীকদমে চার-পাঁচটি পাড়ায় শতাধিক রেংমিটচ্যভাষী পরিবার ছিল। তবে তাঁদের আদি বসবাসের স্থান ৩০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ক্রাংসিপাড়ায়। পাড়াটি আলীকদম উপজেলা সদর থেকে ১৭-১৮ কিলোমিটার দূরে তৈনখালের উপত্যকায় অবস্থিত। সেখান থেকে জুমচাষের জমির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী এলাকায় রেংমিটচ্যরা সমগোত্রীয় ম্রোদের সঙ্গে মিলেমিশে আরও তিন-চারটি পাড়া গড়ে তোলেন। তখন থেকে তাঁরা সংখ্যায় বেশি একই সংস্কৃতির ম্রোদের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকেন এবং রেংমিটচ্য ভাষাও হারিয়ে যেতে থাকে।
ম্রো জনগোষ্ঠী নিয়ে ক্লাউস-ডিয়েটার ব্রাউনস ও লোরেন্স জি লোফলার ১৯৬০-এর দশকে ম্রো হিল পিপল অন দ্য বর্ডার অব বাংলাদেশ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন আরাকান থেকে আসা খামি নামে রেংমিটচ্য ভাষার একটি উপজাতি মাতামুহুরী উজানের ম্রোদের সঙ্গে মিশে গেছে।
সেখান থেকে বোঝা যায়, রেংমিটচ্য ভাষা তখন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। ওই বইয়ের সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ডারমুথ কলেজের লিংগুইস্টিকস অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন ২০১৩ সালে রেংমিটচ্য ভাষার ম্রোদের খুঁজে পেয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি বান্দরবান প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতার কথা তুলে ধরেন।
রেংমিটচ্য জানা প্রবীণ পায়া ম্রো (এখন মৃত) ২০১৫ সালে বলেন, তাঁদের ভাষা হঠাৎ করে বিপন্ন হয়নি। শত বছর ধরে হয়েছে। তবে ১৯৮০–এর দশকে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতির কারণে রেংমিটচ্য ভাষার ম্রোরা অধিকাংশই মিয়ানমার ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গহিন বনাঞ্চলে চলে যান। তখন পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যাঁরা চলে গেছেন তাঁরাও অন্য ভাষাভাষীর সঙ্গে মিশে নিজেদের ভাষা হারিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেছেন, কোনো ভাষার বিপন্নতা ও বিলুপ্তির অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বিভক্তি ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। বিভক্ত জনসংখ্যা অন্য জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যায় মিশে যায় এবং ভাষা হারিয়ে ফেলে। রেংমিটচ্য ভাষার বিপন্নতার জন্যও এটা প্রধান কারণ হতে পারে।
বিপন্ন রেংমিটচ্য ভাষা বিলুপ্ত হবে?
ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতি গ্রন্থের লেখক, বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংয়ং ম্রো বলেছেন, রেংমিটচ্য জানা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ২০১৩ সালে ৩৬ জনকে পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে (২০২২ সালে) সাবলীলভাবে বলতে পারা মানুষের সংখ্যা ছয়জনে নেমে এসেছে। মানুষ প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা শেখে পরিবারে।
েংমিটচ্য ভাষা জানা কয়েকজন থাকলেও এই ভাষাভাষীর কোনো পরিবার নেই। এ কারণে ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্য শেখার কোনো পরিবেশও নেই। তারা সবাই ম্রো ভাষা শিখছে ও কথা বলছে। জীবিত বয়স্কদের মৃত্যু হলে এ ভাষায় কথা বলার আর কেউ থাকবে না।
খুমি ও ম্রো ভাষার গবেষক ডেভিড এ পিটারসন বলেছেন, তিনি মিয়ানমারে গিয়ে রাখাইন ও চিন স্টেটে রেংমিটচ্য ভাষার জনগোষ্ঠীর সন্ধান করেছেন। কিন্তু কোনো খোঁজ পাননি এবং রেংমিটচ্য নামের কোনো ভাষা সম্পর্কে সেখানে কারও ধারণা নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশের জীবিত ছয়জন রেংমিটচ্য জানা ব্যক্তির মৃত্যু হলে ভাষাটিও বিলুপ্ত হবে। তবে ডেভিড এ পিটারসন রেংমিটচ্যভাষীদের নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে রেখেছেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মো. শাফীউল মুজ নবীন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তাঁদের বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় সমতলে ও পাহাড়ে পাওয়া ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিপন্ন ভাষার মধ্যেও পার্বত্য চট্টগ্রামের রেংমিটচ্য ভাষা, সমতলের পাত্র জনগোষ্ঠীর লালেং ভাষা গুরুতর সংকটাপন্ন। সংকটাপন্ন লালেং ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।