যে কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি ডাবের দাম ১৫০ টাকা

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিনে ১৫০ টাকায় ডাব কিনছেন পর্যটকেরা। সম্প্রতি দ্বীপের জেটিঘাট বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

নারকেলগাছে ভরপুর বলে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আরেক নাম ‘নারকেল জিঞ্জিরা’। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ এই দ্বীপে যাঁরা ভ্রমণে যান, তাঁদের খাদ্যতালিকায় আবশ্যিক থাকে ‘ডাব’। কারণ, এখানকার ডাবের পানি খুবই মিষ্টি, আকারও বড়।

তিন বছর আগেও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার এই দ্বীপে প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকায়। প্রতিটি ডাবে গড়ে তিন গ্লাস পানি পাওয়া যেত। এখন সেন্ট মার্টিনে ডাব বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। তিন গুণ দামে বিক্রি হলেও, আকারে ছোট এসব ডাবে এক গ্লাস পানি পাওয়া যায়। হঠাৎ করে ডাবের দাম এত বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল অন্য রহস্য।

সম্প্রতি (২৩ জানুয়ারি) সেন্ট মার্টিনের জেটিঘাট বাজার, পশ্চিম পাড়া, মাঝিরপাড়া, দক্ষিণ পাড়া, পূর্ব পাড়া সৈকত এলাকায় দেখা গেছে, শতাধিক ডাব বিক্রির দোকান। সেখানে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে ডাবের পানি পান করছেন পর্যটকেরা।

দুপুরে জেটি ঘাটের একটি দোকানে ১৫০ টাকায় কিনে ডাবের পানি পান করছিলেন কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান। ডাবের পানি মুখে দিতে দিতে তিনি (আইনজীবী) বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছোট আকারের ডাবের দাম এত বেশি কেন? দোকানদার গিয়াস উদ্দিন (১৯) সরাসরি উত্তর দিলেন, এই ডাব সেন্ট মার্টিনের গাছের না। ১২০ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজারের রামু থেকে কিনে আনা হয়েছে।

পাঁচ বছর আগেও পুরো দ্বীপে নারকেলগাছ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০০টি। এখন সব মিলিয়ে ৬ হাজারের মতো নারকেলগাছ আছে।

কথা শুনে হতবাক আইনজীবী আয়াছুর রহমান (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছর আগে তিনি সেন্ট মার্টিনের ডাবের পানি দিয়ে তিনি গোসল করেছিলেন। ডাবের আকারও ছিল অনেকে বড়। দাম ছিল ২০-৩০ টাকা। পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়ে ডাবের চাহিদাও অনেক বেড়ে গেছে। চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নিতে বাইরের ডাবকে সেন্ট মার্টিনের ডাব বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

১২৫ বছর আগে ৫০-৬০ জনের ১৩টি পরিবারের বসতি শুরু, বর্তমানে দ্বীপের বাসিন্দা ১০ হাজার ৮০০ জন। এখন দৈনিক অন্তত পাঁচ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ করছেন। সময়ে সংখ্যাটা বেড়ে ১৫ হাজারে গিয়ে ঠেকে। পর্যটন মৌসুমের চার মাসে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দ্বীপে অন্তত ছয় লাখ ডাবের চাহিদা থাকে।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর আগেও পুরো দ্বীপে নারকেলগাছ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০০টি। কয়েক বছরে আড়াই হাজারের বেশি নারকেলগাছ কেটে তৈরি হয়েছে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ আর বসতি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়েছে বেশ কিছু গাছ। এখন সব মিলিয়ে ৬ হাজারের মতো নারকেলগাছ আছে। বছরে তিনবার গাছ থেকে ডাব কাটা হয়।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস সেন্ট মার্টিনে পর্যটকে গিজগিজ অবস্থা হয়

ফিরোজ আহমদ খান বলেন, বছরের ৮ মাস (মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত) সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের সমাগম থাকে না, পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও বন্ধ থাকে। তখন সেন্ট মার্টিনের ডাব বিক্রি হয় টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার শহরে। আর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস যখন সেন্ট মার্টিনে পর্যটকে গিজগিজ অবস্থা, তখন গাছের ডাব দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় হাজার পর্যটকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। চাহিদা পূরণে বাইরের জেলা থেকে চড়া মূল্যে ডাব কিনে আনতে হচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ৯০ শতাংশ গাছে এখন ডাব নেই। দ্বীপের পশ্চিম সৈকত লাগোয়া পশ্চিম পাড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শ নারকেলগাছ। অধিকাংশ গাছে নারকেল নেই। এ পাড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী জমির হোসেনের বাড়িতে নারকেলগাছ আছে ২৬টি। কোনোটিতে ডাব নেই। কারণ জানতে চাইলে জমির হোসেন (৪৫) বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে গাছের সব ডাব তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। প্রতিটি ডাব বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা দরে। ২১৫টি ডাব বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ১৭ হাজার ২০০ টাকা। এর আগের অক্টোবর মাসে ২৬টি গাছের ৩৫০টি ডাব বিক্রি করে পেয়েছেন ২৮ হাজার টাকা।

একই গ্রামের জাফর আলমের ৬২টি গাছ থেকে গত ডিসেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ডাব। প্রতিটি ডাব ৯০ টাকা দরে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। জাফর আলম (৫৫) বলেন, আগে একটি ডাবে তিন গ্লাস পানি পাওয়া যেত, এখন এক গ্লাসের বেশি না। টাকার জন্য গাছের ছোট ছোট ডাব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নারকেলগাছ

দ্বীপের মধ্যভাগের গলাচিপার কৃষক নুর কামাল (৪০) বলেন, তাঁর বাগানের ৮০টি গাছে প্রায় ৪ হাজার ডাব আছে। ডাবগুলো ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে বিক্রির উপযোগী হবে। এখন থেকে একজন ব্যবসায়ী গাছের সব ডাব ১০০ টাকা দরে অগ্রিম কিনে রেখেছেন।
কয়েকজন ডাব ব্যবসায়ী বলেন, দ্বীপে পর্যটকদের চাহিদা পূরণে টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, রামু, চকরিয়া উপজেলা থেকে ডাব কিনে আনা হচ্ছে। বরিশাল, ভোলা, কুমিল্লা, নোয়াখালী থেকেও আনা হয় প্রচুর ডাব। প্রচণ্ড শীতে ডাবের পানি পানের অভ্যাস অনেকের থাকে না। কিন্তু সেন্ট মার্টিন গেলে সবাই একবার ডাবের পানি মুখে দিতে চান।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নের নবনির্বাচিত (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, এখন প্রতিদিন সেন্ট মার্টিনে চার-পাঁচ হাজার ডাব বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা পূরণের জন্য কিছু ডাব বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে। এ কারণে দামও বেশি।

সেন্ট মার্টিন বাজারের ডাব বিক্রেতা সৈয়দ আলম (৪৫) বলেন, কক্সবাজার সৈকতে এখন ডাব বিক্রি হয় ৬০-৭০ টাকায়। শীতকালে সেখানে ডাব তেমন বিক্রি হচ্ছে না। সেই ডাব ট্রাক বোঝাই করে ১০০ কিলোমিটার দূরে টেকনাফে আনা হয়। এরপর টেকনাফ থেকে ট্রলার বোঝাই করে ৩৪ কিলোমিটারের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পৌঁছাতে প্রতিটি ডাবের দাম পড়ে ১২০-১২৫ টাকা। এই ডাব সেন্ট মার্টিনে বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা লাভে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। দাম বেশি হলেও পর্যটকেরা মন খারাপ করেন না, কারণ তাঁরা জানেন, এগুলো সেন্ট মার্টিনেরই ডাব।