উত্তরবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর উন্নত সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিত করতে যমুনা নদীর ওপর আরও একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে এই সেতু ঠিক কোন স্থানে নির্মিত হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ইতিমধ্যেই প্রাক্-জরিপ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ১৯ সদস্যের জরিপ দল ইতিমধ্যেই বগুড়ার সারিয়াকান্দির কালিতলা ঘাট থেকে জামালপুরের মাদারগঞ্জের জামথল ঘাট পর্যন্ত যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের জন্য ট্রাফিক সার্ভে শেষ করেছে। যমুনা নদীতে আরেকটি সেতু নির্মাণের খবরে উচ্ছ্বসিত যমুনার দুই তীরের মানুষ।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের হয়ে জরিপ পরিচালনা করছে দেব কনসালট্যান্টস লিমিটেডের ১৯ সদস্যের একটি দল। দলনেতা শাহেদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপ কমাতে যমুনা নদীর ওপর আরেকটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে সেই সেতু কোথায় নির্মিত হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যমুনায় আরেকটি সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত বছরের ২১ নভেম্বর থেকে প্রাক্–জরিপকাজ শুরু হয়। সেই জরিপের অংশ হিসেবে বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার মধ্যে সড়ক সংযোগ স্থাপনে ট্রাফিক জরিপ ২৪ মার্চ শেষ হয়েছে।
জরিপ দল সূত্রে জানা যায়, এই জরিপে মূলত সারিয়াকান্দির কালিতলা নৌ ঘাট থেকে নৌকাযোগে যমুনা পারাপারে যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেলচালকদের কাছে সেতু নির্মাণের গুরুত্ব, নদী পারাপারে টোল হার, সময় ও খরচ নিয়ে প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছে। সেতু নির্মাণ হলে টোল হার নিয়েও প্রশ্ন রাখা হয়েছে স্থানীয় লোকজনের কাছে।
জরিপ দলের দলনেতা জানান, বগুড়া-জামালপুর নৌপথে প্রতিদিন হাজারো মানুষ নৌকায় যমুনা পারাপার করেন। ট্রাফিক জরিপে উঠে আসে সেতুটি নির্মাণ করা হলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর মধ্যে সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ সহজ হবে। বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা যেতে সড়কপথের দূরত্ব কমবে ৮০ কিলোমিটার। উত্তরাঞ্চলের মানুষ ময়মনসিংহ এবং রাজধানী ঢাকায় যেতে পারবে কম সময়ে।
শাহেদুল ইসলাম বলেন, এর আগে গাইবান্ধার বালাসী থেকে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কদমতলী বাজার, বালাসী ঘাট এবং কুড়িগ্রামের চিলমারী ও রাজীবপুর পয়েন্টেও জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। অন্যদিকে আরিচা-নগরবাড়ী পয়েন্টে কিংবা আশপাশে আরেকটি সেতু নির্মাণের জন্য পাবনার সুজানগর ও নাজিরগঞ্জের মধ্যেও জরিপ হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯১২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ রেলঘাট চালু হয়। পরে ১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ রেলঘাট পর্যন্ত নৌপথে ফেরি চলাচল শুরু হয়। এই নৌপথে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলার বাসিন্দারা বাহাদুরাবাদ স্টেশন থেকে ট্রেনে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ যাতায়াত করতেন।
১৯৮৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় যমুনা নদীর গতিপথ বদলে যায়। এতে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। এ কারণে ফেরিসেবা তিস্তামুখ ঘাট থেকে বালাসী ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর পর প্রথমে যাত্রীবাহী ট্রেন ও পরে মালবাহী ওয়াগন পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় যমুনার এপারে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কালীতলা ও মথুরাপাড়া নৌঘাট হয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ ও কাজলাঘাটে মানুষের যাতায়াত। সারিয়াকান্দি থেকে জামালপুরের মাদারগঞ্জ নৌঘাটের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। সারিয়াকান্দি থেকে মাদারগঞ্জ নৌকায় জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। রিজার্ভ নৌকা ভাড়া ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা। মোটরসাইকেল পারাপারের ভাড়া ১০০ টাকা। গত বছরের আগস্ট মাসে নদী পারাপারে বিআইডাব্লিউটিএ সি ট্রাক চালু করে। তবে দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই বিকল হয় সি ট্রাক। পরে সি ট্রাক প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, বগুড়া-জামালপুর নৌপথে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মিত হলে উত্তরের মানুষের সঙ্গে আবার বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন হবে। কৃষিপণ্যের দ্রুত সরবরাহ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও ঢাকার সড়ক-মহাসড়কে যানজট কমবে। তাই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনার খবর পেয়ে দুই পারের বাসিন্দারা আনন্দিত।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বগুড়ার রওনক হাসান বলেন, বগুড়া থেকে বাসে ময়মনসিংহ যাতায়াতে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দীর্ঘপথ ঘুরে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কপথে বাস যাতায়াতে বাড়তি সময় ও ভাড়া গুনতে হয়। বাধ্য হয়ে সারিয়াকান্দি-মাদারগঞ্জ নৌপথে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় যমুনা পারাপার হয়ে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে হয়। এ পথে যমুনা নদীতে সেতু নির্মিত হলে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।
বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুতে যানবাহন পারাপারে চাপ বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা-উত্তরবঙ্গ সড়কপথের যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
বগুড়া থেকে ঢাকায় কোচ পৌঁছাতে আট থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। বগুড়া-জামালপুর পথে যমুনায় আরেকটি সেতু নির্মিত হলে যমুনা সেতুর ওপর চাপ কমবে। উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকায় যাত্রাপথে সময় সাশ্রয় হবে। পরিবহনমালিকেরা অল্প সময়ে বেশি ট্রিপ মারতে পারবেন। যাত্রীদের দুর্ভোগও লাঘব হবে। উত্তরের অর্থনীতির চিত্রও পাল্টে যাবে।