সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া পর্যন্ত যমুনা নদীর বিভিন্ন অংশে নাব্যতা–সংকট প্রকট হয়েছে। এর মধ্যে পাবনার বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলা পয়েন্টে হঠাৎ করেই নদীর গভীরতা এত কমে গেছে যে জাহাজ তো দূরের কথা বলগেটসহ পণ্যবোঝাই ছোট নৌযানগুলোও সেখান দিয়ে যেতে পারছে না। ফলে শুধু এই স্থানেই অন্তত ২৫টি জাহাজ ডুবোচরে আটকে আছে। এ ছাড়া পণ্যবোঝাই আরও অন্তত ২০টি ছোট নৌযানও ওই স্থানে আটকা পড়ে আছে।
কয়েক দিন ধরে জাহাজ ও ছোট নৌযান বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে ঠিকমতো ভিড়তে না পারায় স্থবির হয়ে পড়েছে নৌবন্দরটি। এভাবে চলতে থাকলে উত্তরাঞ্চলজুড়ে তেল ও সারের মারাত্মক সংকট দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিআইডব্লিউটিএ ও চলাচলকারী জাহাজের মাস্টার-সুকানিদের সূত্রে জানা যায়, পাটুরিয়া থেকে বাঘাবাড়ি নৌবন্দর পর্যন্ত যমুনার অনেক স্থানই কয়েক বছর ধরে নাব্যতা–সংকট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ ফুট গভীরতার প্রয়োজন হলেও শুষ্ক মৌসুমে এই নৌ রুটের বিভিন্ন অংশে পানির গভীরতা সাত থেকে আট ফুট বা এরও কমে এসে দাঁড়ায়।
জাহাজ ভিড়তে না পারলে উত্তরাঞ্চলজুড়ে বোরো চাষের এই মৌসুমে সার ও জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চলতি বছরে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বাঘাবাড়ী থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত নৌপথে বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ, পেঁচাকোলা, মোল্লারচর, ব্যাটারিরচর ও লতিফপুরে নাব্যতা–সংকট দেখা দেয়। এসব স্থানে পানির গভীরতা সাত থেকে আট ফুটের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। এ কারণে শুষ্ক মৌসমের শুরু থেকেই সারসহ পণ্যবাহী জাহাজগুলো পাটুরিয়ার কাছে ছোট ছোট নৌযানে আংশিক পণ্য খালাস করে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে ভিড়ছিল।
পেঁচাকোলা পয়েন্টে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো। সামনের একটি চর ভেঙে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।সাজ্জাদ রহমান, পোর্ট অফিসার, বাঘাবাড়ী নৌবন্দর
কিন্তু সপ্তাহখানেক আগে বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলায় নৌপথে হঠাৎ করেই অগভীর ডুবোচরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রতিদিনই ডুবোচরের কাছে পানির গভীরতা কমছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে এই স্থানে নৌপথের কোনো কোনো অংশের গভীরতা চার থেকে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন জাহাজের মাস্টার ও সুকানিরা জানান। এত অল্প গভীরতার কারণে কোনো জাহাজ (অর্ধেক পণ্যবোঝাই) তো দূরের কথা, বলগেটসহ (ইস্পাতের তৈরি মালবাহী নৌকা) ছোট ছোট নৌযানও চলাচল করতে পারছে না। এই স্থান পার হতে গিয়ে ডুবোচরে আটকা পড়ছে একের পর এক জাহাজ।
মঙ্গলবার সরেজমিনে পেঁচাকোলায় দেখা গেছে, অন্তত ২৫টি জাহাজ ডুবোচরে আটকা পড়ে আছে। এ ছাড়া স্থানটি পার হতে না পেরে বলগেটসহ আরও অন্তত ২০টি ছোট নৌযান পাড়ে নোঙর ফেলে আছে। স্থানটিতে নাব্যতা বজায় রাখতে বিআইডব্লিউটিএর তিনটি ড্রেজার রাতদিন কাজ করেও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারছে না।
নোঙর করে থাকা সাদিয়া পরিবহন নামের বলগেটের সুকানি খলিলউদ্দিন ও প্যারাডাইস পরিবহনের সুকানি মো. হোসেন জানান, তাঁরা নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রতিটি বলগেটে ছয় হাজার বস্তা করে সিমেন্ট এনে এই স্থানে আটকা পড়েছেন। এই জায়গায় নৌ চ্যানেল যেমন সরু তেমনি অগভীর। পার হতে না পেরে তাঁরা দুদিন ধরে সেখানে নোঙর করে আছেন বলে জানান।
এবার নাব্যতা–সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বেশ আগে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ সময়মতো ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা নিলে এমন হতো না। বিআইডব্লিউটিএর গাফিলতির কারণেই বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এমন স্থবির হয়ে পড়েছে।আবদুল ওহাব, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন
এদিকে ডুবোচরের কারণে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে জাহাজ ভিড়তে না পারায় স্থবির হয়ে পড়েছে নৌবন্দরটি। অথচ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানি তেল, সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই নৌবন্দর। জাহাজ ভিড়তে না পারলে উত্তরাঞ্চলজুড়ে বোরো চাষের এই মৌসুমে সার ও জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইতিমধ্যে এই নৌবন্দরের প্রায় ৮০০ শ্রমিকের মধ্যে বেশির ভাগই বেকার হয়ে পড়েছেন।
শ্রমিক তদারকির দায়িত্বে থাকা নৌবন্দরের শ্রমিক সরদার আবদুল মজিদ বলেন, নাব্যতা–সংকটের মধ্যে আগে ছোট নৌযানে হলেও মাল আসত। কিন্তু এখন জাহাজের সঙ্গে ছোট নৌযানও একেবারেই কম আসছে। তাই নৌবন্দরের ৮০০ শ্রমিকের বেশির ভাগই এখন বেকার। এ অবস্থায় চরম দুরবস্থায় দিন কাটছে শ্রমিকদের।
নৌবন্দরের ইজারাদার আবদুস সালাম বলেন, এই নৌবন্দরে কোনো জাহাজ না আসায় বন্দরের কার্যক্রম একেবারেই স্থবির হয়ে পড়েছে। এই স্থবিরতার প্রভাবে নৌবন্দরের শ্রমিকেরা আজ বেকার, ইজারাদারদের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে উত্তরাঞ্চলে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বিআইডব্লিউটিএ এর দায় কোনোভাবে এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক আবদুল ওহাব বলেন, এবার নাব্যতা–সংকটের সৃষ্টি হয়েছে বেশ আগে। এখন তা আরও জটিল হয়েছে। অথচ বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ সময়মতো ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা নিলে এমন হতো না। বিআইডব্লিউটিএর গাফিলতির কারণেই বাঘাবাড়ী নৌবন্দর এমন স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক ও বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের পোর্ট অফিসার সাজ্জাদ রহমান বলেন, ‘পেঁচাকোলা পয়েন্টে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো। সামনের একটি চর ভেঙে যাওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এরপরও বিআইডব্লিউটিএ থেকে টের পাওয়া মাত্রই তিনটি ড্রেজার দিয়ে শুধু পেঁচাকোলা পয়েন্টেই রাতদিন ড্রেজিং করছে। আশা করা যাচ্ছে, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ সাজ্জাদ রহমান বলেন, গত সোমবার তাঁরা চারটি তেলের জাহাজ এখান দিয়ে বন্দরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। গতকাল বিকেল পর্যন্ত একটি জাহাজের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন।