মৌলভীবাজারে দুর্গাবাড়ির পূজায় এবার নারী নেতৃত্ব

শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ি পূজা পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে নারী নেতারা। গত সোমবার দুপুরে মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজার এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ি পূজা পরিচালনা পরিষদের বৈঠকে নারী নেতারা। গত সোমবার দুপুরে মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজার এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো

দু-একের মধ্যেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার ঢাকে কাঠি পড়তে যাচ্ছে। ষষ্ঠীপূজার শাঁখ বেজে উঠবে ওই দিন। এরপরই মণ্ডপে মণ্ডপে পড়বে দেবীদর্শনে উপচে পড়া ভিড়। মৌলভীবাজারে এবার সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হবে সর্বজনীন দুর্গোৎসব। প্রতিমা ও মণ্ডপের সাজসজ্জায় কে কাকে টপকে যাবে, তার একটা মৌন ইঁদুরদৌড় থাকলেও এবার শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ির পূজা শুরুর আগেই সবার মান্যতা আদায় করে নিয়েছে। এই পূজা কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বে প্রথা ভেঙে এবার চমক হয়ে এসেছেন নারীরা।

মৌলভীবাজারের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজাগুলোর মধ্যে এই পূজা সুবিদিত। প্রায় ৮০ বছর ধরে মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজার এলাকায় শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়িতে শারদীয় দুর্গাপূজা হচ্ছে। তবে পূজা পরিচালনা কমিটিতে বরাবরই নেতৃত্বে থেকেছেন পুরুষ সদস্যরা। মাঝেমধ্যে নারীরা ছিলেন, তবে কেউ সামনের সারিতে থেকে কখনো নেতৃত্ব দেননি। এবারই প্রথম নারীরা এই মণ্ডপের শীর্ষ নেতৃত্বে এসেছেন। ২৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ ১০টি পদে রয়েছেন নারীরা।

শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ি পূজা পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হয়েছেন প্রতিমা রায় এবং সাধারণ সম্পাদক লাভলী রানী দেবনাথ। সহসভাপতি আশা রানী দত্ত, সহসাধারণ সম্পাদক পিংকি রায়, প্রচার সম্পাদক নন্দিতা দেব, সাংস্কৃতিক সম্পাদক চন্দ্রিমা সোম এবং সদস্য কাউন্সিলর শ্যামলী দাস পুরকায়স্থ, ইতিশ্রী দত্ত, মমতা রানী দেব ও স্বাগতা সরকার।

দুর্গাবাড়ির প্রতিমা তৈরিতে মাটির কাজ শেষ। এখন শুরু হবে রং করার পালা। গত সোমবার দুপুরে মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজারে। ছবি: প্রথম আলো

শুধু গৎবাঁধা দায়িত্ব নিয়েই থেমে থাকেননি এই নারীরা, প্রথমবার নেতৃত্বে এসেই নতুন কিছু করতে চেয়েছেন তাঁরা। এর আগে মৌলভীবাজারে দেবীর আগমনী বার্তার অনুষ্ঠান মহালয়া কখনো হয়নি। এবার মহালয়ার আয়োজন করেছে শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ি পূজা কমিটি। গত শনিবার এ মহালয়া অনুষ্ঠানে ছিল জেলার শীর্ষ নারী কর্মকর্তাদের ছড়াছড়ি। মহালয়া উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিকা দে। পুরো অনুষ্ঠানই যেন নারীময় হয়ে উঠেছিল। দেবী দুর্গাকে নারীশক্তির প্রকাশ মানা হয়। এই নারীদের নেতৃত্বে যেন দেবী দুর্গারই আরেক রূপ।

মহালয়ায় বের করা হয় রঙিন শোভাযাত্রা। সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে করা হয় বস্ত্র বিতরণ। আলোচনা সভায় সভামঞ্চ আলোকিত করে বসেছিলেন নারীরাই।

শ্রীশ্রী দুর্গাবাড়ি পূজা পরিচালনা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে চাম্পালাল শান্ডো নামের এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী প্রায় ৮০ বছর আগে এই দুর্গাবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকেই এখানে শারদীয় দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়ে আসছে।

গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিমা নির্মাণের তোড়জোড়ে ব্যস্ত কারিগরেরা। মাটির কাজ শেষ করে বেশ কয়েকটি প্রতিমায় রংতুলির আঁচড় দিচ্ছেন তাঁরা। দুর্গাবাড়ির পাশের একটি বাসায় কমিটির সদস্যরা এদিন বৈঠকেও বসেছিলেন। এ রকম তাঁরা মাঝেমধ্যেই বসে পরিকল্পনা করছেন। নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করছেন। প্রথম দায়িত্ব গ্রহণের জড়তা কাটিয়ে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কীভাবে আরও সুন্দরভাবে পূজা সম্পন্ন করা যায়, সেটাই এখন তাঁদের ভাবনায়।

সভাপতি প্রতিমা রায় গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীরা সব সময়ই কাজ করেন। কিন্তু তাঁরা সামনে থাকেন না। এবার আমরা সামনে এসেছি। পুরুষেরা যা পারেন, আমরাও যে তা পারি, এটুকু করে দেখাতে চাই।’ সাধারণ সম্পাদক লাভলী রানী দেবনাথ বলেন, ‘আমরা নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। কিছুটা অনভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। তবে পুরুষেরা আমাদের সব রকম সহযোগিতা করছেন।’

বৈঠকে উপস্থিত দুর্গাবাড়ি পূজা কমিটির সদস্য প্রাণ গোপাল রায় বলেন, ‘পরিচালনা পরিষদ গঠনের সভায় নারীদের নেতৃত্বের প্রস্তাব সবাই সমর্থন করেছে। নারীরা অনেক কিছু করেন। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন পদে নারীরা আছেন। কিন্তু সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা অবহেলিত। পূজা কমিটিতে প্রথাভাঙার কাজটা তাই আমরাই শুরু করলাম।’