জেলায় আওয়ামী রাজনীতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে পরিচিত মোহতেশাম। তাঁর গ্রেপ্তারকে নেতা-কর্মীরা ‘কলঙ্কমুক্তি’ হিসেবে দেখছেন।
সরকারি দরপত্র থেকে কমিশন আদায়, চাকরি–বাণিজ্য ও বিরুদ্ধাচরণকারীদের দমনসহ নানা অপকর্মের মধ্য দিয়ে ফরিদপুরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবর। অভিযোগ হচ্ছে, ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁরই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মোহতেশাম।
দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় খন্দকার মোহতেশামকে গ্রেপ্তারের পর গত মঙ্গলবার ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ। জেলায় আওয়ামী রাজনীতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ মোহতেশামের এই গ্রেপ্তারকে অনেকে ‘কলঙ্কমুক্তি’ হিসেবেও দেখছেন। তবে ২০০৯ সালের পর থেকে দলের যেসব নেতা-কর্মী ক্ষমতার লোভে মোহতেশামদের হয়ে নানা অপকর্ম করেছেন বা তাঁর সহযোগী ছিলেন, তাঁরাই এখন ভোল পাল্টে ‘ত্যাগী নেতা-কর্মীদের’ দলে ভিড়তে চেষ্টা করছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তবে ভাইয়ের অপকর্মের বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী ও ফরিদপুর-৩ আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবর (মোহতেশাম) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তিনি ব্যবসা করতেন, রাজনীতি করতেন। ব্যবসা করলে উন্নতি হবে, এটি সহজ কথা। এমপি-মন্ত্রীদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন ব্যবসা করবে, এতে দোষের কিছু নেই। সে জন্য বলা যায়, এটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা আমার জন্য বিব্রতকর।’
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, খন্দকার মোহতেশাম বিএনপির রাজনীতি করতেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তাঁর বড় ভাই খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচন করেন। তখন মোহতেশাম ছিলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ঘনিষ্ঠ। তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্বেও ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে খন্দকার মোশাররফ মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগে সক্রিয় হতে থাকেন মোহতেশাম। কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন জেলা আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সহসভাপতি।
জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক বলেন, খন্দকার মোশাররফ নিজের প্রয়োজনে, অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য মোহতেশামকে কাছে টেনে নেন। নির্বাচনের কোনো ভূমিকা পালন না করলেও নির্বাচিত হওয়ার পর বিভিন্ন সেক্টর থেকে অবৈধ টাকা উপার্জন এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তাঁর ভাইকে যোগ্য মনে করেছিলেন। এ কারণেই ভাইয়ের প্রভাব-প্রশ্রয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন মোহতেশাম।
ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর মোহতেশাম জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মোকাররম মিয়া ওরফে বাবু, খন্দকার মোশাররফের এপিএস ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ মুখার্জি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠজন বিল্লাল হোসেনকে নিয়ে নিজস্ব চক্র তৈরি করেন। পরবর্তী সময়ে আরও যুক্ত হন শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলসহ অনেকে। যে মামলায় মোহতেশাম গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই মামলায় আগে থেকেই কারাগারে আছেন আলোচিত দুই ভাই রুবেল-বরতক।
দলীয় নেতা–কর্মীরা বলছেন, রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করেন মোহতেশাম। তিনি উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের কোনো সভা হতো না। তিনি উপস্থিত হন বা না হন, অনুষ্ঠানের ব্যানারে অতিথি হিসেবে নাম থাকা ‘বাধ্যতামূলক’ ছিল।
খন্দকার মোহতেশামের ‘ইশারায়’ ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি শওকত আলী, ছাত্রলীগের সভাপতি মনির হোসেনসহ বিভিন্নজনকে কুপিয়ে জখম করেন বলে অভিযোগ আছে। মোহতেশামের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ায় এই হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ।
মোহতেশামের নির্দেশে পুলিশ এসব ঘটনার কোনোটিতেই আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনই একটি ঘটনার ভুক্তভোগী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ঝর্না হাসান। তিনি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা হাসিবুল হাসানের স্ত্রী।
২০১১ সালের অক্টোবরে শহরের আলীপুর মহল্লায় ঝর্না হাসানের বাড়িতে হামলা হয়। পেট্রল দিয়ে বাড়িতে আগুন লাগানোর চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় ১০ জনের নামে মামলা করেন ঝর্না হাসান। তিনি বলেন, ওই মামলায় মোহতেশামের নির্দেশে পুলিশ মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা রাজনীতিতে মোশাররফপন্থী হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালের সম্মেলনে ‘মোশাররফের প্রার্থী’ হিসেবে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এটিই ছিল তাঁর পরিচয়। ওই বছরের ১৬ মে সুবল সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলা হয়। এ হামলার ধারাবাহিকতায় ৭ জুন ফরিদপুরে ঘটে যায় নানা ঘটনা। জেলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হন খন্দকার মোশাররফ। গ্রেপ্তার হন সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত এবং তাঁর ভাই ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলসহ মোশাররফের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী।
রুবেল-বরকতদের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে খন্দকার মোহতেশামের সম্পৃক্ততা। বরকত–রুবেলের অর্থ পাচারের ঘটনায় সিআইডির করা মামলার অভিযোগপত্রে মোহতেশামকেও আসামি করা হয়। সেই মামলার পলাতক আসামি মোহতেশামকে গত ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়।
সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘বাবরকে গ্রেপ্তার করে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের জন্য আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। এ ঘটনায় প্রমাণ করে, দলে থেকে তিনি যত বড় নেতা হোন না কেন, দুর্নীতি করলে তাঁকে সাজা পেতে হবে।’
একসময় দ্বন্দ্ব থাকলেও ২০১৭ সালের পর মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঝর্না হাসান রাজনীতি করতেন বলে প্রচার আছে। তবে ‘মোশাররফপন্থী নন’ দাবি করে ঝর্না হাসান বলেন, ‘সাত বছর ধরে মোশাররফ ও তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। পাশে অমিতাভ (জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক) আর মনির হোসেন ছাড়া কাউকে পাইনি। এখন তো সবাই ত্যাগী আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন। সেদিন দেখলাম আনন্দ মিছিল হয়েছে বাবরের গ্রেপ্তারের পর। মিছিলে যাঁদের দেখলাম, তাঁদের মধ্যে মোশারফকে যাঁরা মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছেন, হেলমেট বাহিনী হাতুড়ি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের দেখলাম। তাঁরা আজ নির্যাতিত তৃণমূল হয়ে আওয়ামী বনে গেছেন আর আমরা হয়েছি হাইব্রিড।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী মে মাসের মাঝামাঝি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হতে পারে। ওই সম্মেলনে জেলা নেতৃত্বে কারা আসছেন, সেটাই আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করছেন তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
বিগত সময়ে মোশাররফপন্থীদের ভিড়ে নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারা বজায় রেখেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা একসময় বাবর এবং সরকারপন্থী হয়ে আমাদের উপর হামলা চালিয়েছিল, নির্যাতন করেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতি পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ভোল পাল্টে বিভিন্ন গ্রুপে মিশে গেছে। এই অবস্থায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না আগামী কাউন্সিলে যোগ্য নেতাদেরই মূল্যায়িত হবে, নাকি আগেকার সুবিধাভোগীরা ঢুকে যাবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম হকও বললেন, ‘মোশাররফ-মোহতেশাম চক্রের অনেকেই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের মিশে গেছেন। তবে আমরা সন্ত্রাসের যুগে, নৈরাজ্যের সময়ে ফিরে যাব না।’