মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি জুনে

এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮২ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে শুধু জুনে মারা গেছেন ৪৪ জন।

করোনাভাইরাস

করোনা মোকাবিলায় সবার অগ্রভাগে স্বাস্থ্যকর্মীরা। চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল স্টাফরা কাজ করছেন সম্মুখসমরের যোদ্ধা হয়ে। এতে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারাও যাচ্ছেন তাঁরা। সারা বিশ্বে ৭ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে। দেশে করোনা সংক্রমণের ৬ মাসে মারা গেছেন ৮২ জন চিকিৎসক, যার অর্ধেকের বেশি জুনে। আর নার্স মারা গেছেন ১২ জন।

করোনায় মৃত্যু

■ শুধু সরকারি নার্স আক্রান্ত হয়েছেন হাজার ৬৫০ জন। বেসরকারি সব হাসপাতালের হিসাব ঠিকমতো পাওয়া যায় না।

■ এ পর্যন্ত হাজার ৮৬৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে হাজার ৭২২ জন চিকিৎসক, হাজার ৯৪৩ জন নার্স ও হাজার ২০১ জন মেডিকেল স্টাফ।

সূত্র: বিএমএ

অন্য দেশের তুলনায় শুরুর দিকে আক্রান্তের হার বেশি ছিল। এখন সব দিকেই উন্নতি হয়েছে। ফলে চিকিৎসকেরাও কম আক্রান্ত হচ্ছেন।
এহতেশামুল হক চৌধুরী, বিএমএ মহাসচিব

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বলছে, এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৮২ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে শুধু জুনেই মারা গেছেন ৪৪ জন। গত দুই মাসে মারা গেছেন ১২ জন করে। আর এ মাসে এখন পর্যন্ত একজন চিকিৎসকের মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আর মার্চে কেউ মারা না গেলেও এপ্রিলে মারা যান একজন।

বিএমএ মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আক্রান্তের ৮০ শতাংশই শুরুর দিকে। অন্য দেশের তুলনায় শুরুর দিকে আক্রান্তের হার বেশি ছিল। এখন সব দিকেই উন্নতি হয়েছে। ফলে চিকিৎসকেরাও কম আক্রান্ত হচ্ছেন। তিনি জানান, যাচাই-বাছাই করেই করোনায় মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করে বিএমএ। ৮২ জনের বাইরে আরও তিনটি মৃত্যুর তথ্য যাচাই চলছে এখন।

তবে বাংলাদেশ ডক্টরস ফোরামের (বিডিএফ) প্রধান সমন্বয়ক নিরুপম দাশ বলছেন, একজন শিক্ষার্থীসহ মারা গেছেন ১১১ জন চিকিৎসক। প্রত্যেক চিকিৎসকের বিস্তারিত তথ্য আছে তাদের কাছে। নার্স মারা গেছেন ১২ জন ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন সাতজন। সব মিলে স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন ১৩০ জন।

চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টরা বলছেন, সংক্রমণের শুরুর দিকে সুরক্ষাসামগ্রীর অপ্রতুলতা, অব্যবস্থাপনা, সচেতনতার অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি হারে আক্রান্ত হয়েছেন। সেসব সমস্যা কমে আসায় এখন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে এসেছে। বিএমএ বলছে, এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৮৬৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৭২২ জন চিকিৎসক, ১ হাজার ৯৪৩ জন নার্স এবং ৩ হাজার ২০১ জন মেডিকেল স্টাফ। আর বিডিএফ বলছে, আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২ হাজার ৯৩৬ জন।

তবে বাংলাদেশ নার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ২ হাজার ৩০০–এর বেশি। এ সংগঠনের সভাপতি ইসমত আরা পারভিন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু সরকারি নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬৫০ জন। বেসরকারি সব হাসপাতালের হিসাব ঠিকমতো পাওয়া যায় না।

করোনা রোগীদের কাছাকাছি থেকে সেবা দিচ্ছেন নার্স ও ল্যাব টেকনোলজিস্টরা। আক্রান্তও হয়েছেন বেশি হারে। বিশেষ করে নমুনা সংগ্রহ ও নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকা ল্যাব টেকনোলজিস্টরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তাঁদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম। করোনার উপসর্গ নিয়ে চারজনের মৃত্যু হলেও আক্রান্ত হয়ে ল্যাব টেকনোলজিস্ট মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই। আক্রান্ত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি।

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে তিন হাজার ল্যাব টেকনোলজিস্ট করোনা পরীক্ষায় সারা দেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। ৯৫ শতাংশ সুস্থ হয়েছেন। তবে আগের চেয়ে আক্রান্তের হার কমে এসেছে বলে জানান তিনি।

ক্ষতিপূরণে দীর্ঘসূত্রতা

জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক মাহমুদ মনোয়ারের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় গত ৯ জুন। পরদিন জ্বর বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১২ জুন মারা যান তিনি। ছোট দুটি শিশু নিয়ে সংসারে এখন হিমশিম খাচ্ছেন তাঁর চিকিৎসক স্ত্রী নুসরাত জাহান। তিনিও করোনা থেকে সেরে উঠেছেন। স্বামীর পেনশনের কাগজপত্র নিয়ে একাই ছুটছেন প্রতিদিন।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে হতাশা প্রকাশ করে নুসরাত জাহান বলেন, করোনার ক্ষতিপূরণের জন্য হাসপাতাল নিজ থেকেই আবেদনের সব কাগজ পাঠানোর কথা বলেছিল। এত দিনেও সেই ফাইল হাসপাতাল থেকে বের হয়নি।

করোনায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর জন্য গত এপ্রিলে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন পাঁচ লাখ টাকা, আর মারা গেলে পাবেন ২৫ লাখ টাকা। ১০ থেকে ১৪তম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে সাড়ে সাত লাখ টাকা আর মারা গেলে পাবেন সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কেউ আক্রান্ত হলে পাবেন ১০ লাখ টাকা এবং মারা গেলে পাবেন ৫০ লাখ টাকা।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অসুস্থ হন নার্স শেফালি রানী দাস। ২৮ এপ্রিল তাঁর করোনা শনাক্ত হয়। এরপর দুই দফায় পরীক্ষা করে করোনামুক্ত হওয়ার কথা জানতে পারেন। কিন্তু ২৮ মে হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান। তাঁর স্বামী বিজন কুমার দে প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণের বিষয় জানা নেই। হাসপাতাল থেকেও কিছু জানায়নি।

দেশে করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৫ এপ্রিল। সিলেট মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমদের পরিবার ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আর কোনো চিকিৎসক ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানিয়েছে বিডিএফ।