টাঙ্গাইলের শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। নতুন প্রজন্ম যেখানে গিয়ে জানতে পারছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারুল আলম তাঁর টাঙ্গাইল শহরের বাসভবনে গড়ে তুলেছেন এই জাদুঘর। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা তুলে ধরতেই তাঁর এই উদ্যোগ।
আনোয়ারুল টাঙ্গাইল জেলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একজন নেতা হিসেবে স্বাধীনতা-পূর্ব বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সম্ভাব্যতা সামনে রেখে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর একজন সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ছিলেন টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর (যা কাদেরিয়া বাহিনী হিসেবে পরিচিত) বেসামরিক প্রধান। যুদ্ধ শেষে তিনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পরিচালক হিসেবে রক্ষী বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রক্ষী বাহিনীকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হয়। আনোয়ারুল সেনাবাহিনীতে লে. কর্নেল হিসেবে একীভূত হন। তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। কূটনীতিক হিসেবে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি স্পেনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। চাকরিজীবনে যেখানে গেছেন, সেখানেই নিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, যুদ্ধকালীন নানা দলিল-দস্তাবেজ।
আনোয়ারুল ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণের পর টাঙ্গাইল শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৈতৃক ভিটায় দোতলা ভবন নির্মাণ করেন। এই ভবনের নিচতলাতেই গড়ে তুলেছেন জাদুঘর। ২০১০ সালে জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। এই জাদুঘর যাঁরা দেখতে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই তরুণ প্রজন্মের। দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্টজনও জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন। বাসায় থাকলে আনোয়ারুল নিজে দর্শনার্থীদের ঘুরে দেখান জাদুঘরের বিভিন্ন স্মারক। ছবি দেখিয়ে বর্ণনা করেন যুদ্ধদিনের ইতিহাস।
সরেজমিনে জাদুঘরে দেখা যায়, নিচতলাজুড়ে সাজানো মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত একুশের সংকলন, আন্দোলন-সংগ্রামে দিকনির্দেশনা দিয়ে জেলার নেতাদের লেখা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতার চিঠি, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন বীরত্ব থেকে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং বিজয় অর্জনের পর বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের আলোকচিত্র। আরও রয়েছে যুদ্ধ চলাকালীন ও বিজয়ের পর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিবেদনের ছবি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চল থেকে আনোয়ারুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত রণাঙ্গন পত্রিকার কপি, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দলিল, টাঙ্গাইল অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ভারতীয় বাহিনীর প্যারাসুট, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকিস্তানি জাহাজের অংশবিশেষসহ অন্যান্য স্মারক।
গত শনিবার জাদুঘরটি পরিদর্শন করেন একদল তরুণ। তাঁদের একজন সোহাস চৌধুরী বলেন, ‘জাদুঘরটি পরিদর্শন করে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তাঁরা এই জাদুঘর দেখে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব সহজেই জানতে পারব।’
সরকারি সা’দত কলেজের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র আবু কাওছার আহমেদ জানান, জাদুঘরটি দেখে টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব সম্পর্কে তিনি জানতে পেরেছেন। যেন এক ছাদের নিচে পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক শফিউদ্দিন তালুকদার জানান, শহীদ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আনোয়ারুলের একটি মহান উদ্যোগ। তিনি শুধু যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে যুদ্ধকালীন অমূল্য আলোকচিত্র ও বিভিন্ন দলিল দিয়ে জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। এই উদ্যোগ নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ারুল জানান, জাদুঘরে স্থান পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের ছবি ও বিভিন্ন দলিল তিনি সংরক্ষণ করেছেন। জাদুঘরটি শহরের এনায়েতপুর এলাকায় স্থানান্তর করা হবে। সেখানে জাদুঘরের পাশাপাশি তাঁর কাছে সংরক্ষিত প্রায় চার হাজার বইয়ের সমন্বয়ে ‘সাইদা লাইব্রেরি’ স্থাপন করা হবে।