উদ্ধার করা হয়েছে ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান।
উদ্ধার করা হয়েছে ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসান।

শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবি

মামলায় কার্গো জাহাজটির নাম নেই, জব্দও হয়নি

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যানবাহনের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শোনা যায় প্রায়ই। এবার নারায়ণগঞ্জে যাত্রীবাহী লঞ্চকে ধাক্কা মেরে ডুবিয়ে দেওয়ার পর হাজার টন ওজনের বিশাল একটি কার্গো জাহাজকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।

গত রোববার সন্ধ্যার দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট এলাকায় জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ সাবিত আল হাসান। দুর্ঘটনার পর ডুবে যাওয়া লঞ্চের যাত্রীদের উদ্ধার না করে পালিয়ে যায় কার্গো জাহাজটি। ওই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আর জাহাজটিকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জব্দ করা হয়নি।

এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার রাতে ধাক্কা দেওয়া অজ্ঞাত কার্গো জাহাজের চালকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় মামলা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবে মামলায় কার্গো জাহাজ কীংবা এর চালক ও মালিক কারোরই নাম উল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মামলার বিষয়ে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির ঘটনায় কার্গো জাহাজের চালকসহ সংশ্লিষ্ট অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ কার্গো জাহাজটি জব্দসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনবে।

এজাহারে কেন সেই কার্গো জাহাজের নাম নেই জানতে চাইলে মামলার বাদী বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা বাবুলাল বৈদ্য বলেন, ভিডিও ফুটেজে কোথাও ওই জাহাজের নাম দেখা যায়নি। নিশ্চিত না হওয়ায় অজ্ঞাত কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তদন্তে অভিযুক্ত কার্গো জাহাজের নাম বেরিয়ে আসবে।

তবে ঘটনার পর থেকেই পুলিশ, লঞ্চ মালিক সমিতি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধাক্কা দেওয়া কার্গোটির নাম এমভি এসকেএল-৩, যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর এম-০১-২৬৪৩। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাজটির মালিক বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ তন্ময়ের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসকে লজিস্টিকস।

আর ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মালিকপক্ষ বলছে, কার্গো জাহাজটির মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদেরও মামলা করতে দেওয়া হচ্ছে না। বুধবার সারাদিন থানায় থানায় ঘুরেও মামলা করতে পারেনি ডুবে যাওয়া লঞ্চ এমএল সাবিত আল হাসানের মালিক পক্ষ। বুধবার নারায়ণগঞ্জ নৌ থানা ও বন্দর থানায় জাহাজের মাস্টার বাদী হয়ে মামলা করতে গেলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়। লঞ্চ ডুবির সময় সাবিত আল হাসানের দায়িত্বে ছিলেন তৃতীয় শ্রেণির সনদধারী মাস্টার জাকির হোসেন। লঞ্চডুবিতে আহত জাকির চিকিৎসা নিয়ে বুধবার মামলা করতে এসেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চের মালিক পক্ষ মঙ্গলবার মামলা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। পরে বুধবার তিনি মামলা করতে গিয়েছিলেন। সকালে বন্দর থানায় গেলে তাঁদেরকে থানার বাইরে কয়েক ঘন্টা বসিয়ে রেখে মামলা না নিয়ে নারায়ণগঞ্জ নৌ থানায় চলে যেতে বলেন বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। দুপুরের পর নারায়ণগঞ্জ নৌ থানায় গেলে সেখান থেকেও মামলা না নিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় তাদের। এসময় জাকির হোসেনের সঙ্গে ওই লঞ্চের কেরানি মঞ্জুর আলী ও লঞ্চ মালিক সমিতির লোকজনও ছিলেন।

দুর্ঘটনার পর স্পিডবোট নিয়ে ধাওয়া করে এক ব্যক্তি জাহাজটিির এ ছবি তোলেন। তবে জাহাজটিকে আটক করা যায়নি।

মামলা না নেয়ার কারন সম্পর্কে বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর মামলাটির তদন্ত করবে নারায়ণগঞ্জ নৌ থানা। জাহাজের মাস্টারকে আমরা নৌ থানায় পাঠিয়েছি। নৌ থানা চাইলে মামলা নিতে কোন বাধা নেই।’

লঞ্চটির কেরানি মঞ্জুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌ থানার ওসিরে আমরা অনুরোধ করছিলাম তিনি যেন আমাগো মামলটা নেন। তিনি তখন বললেন, একই ঘটনায় দুইটা মামলা করার নিয়ম নাই। আমরা কতোক্ষণ থানায় বইসা থাইকা চলে আসছি।’ বৃহস্পতিবার তারা মেরিন আদালতে মামলা করতে যাবেন বলে জানান মঞ্জুর।

এর আগে মঙ্গলবার ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মালিক আলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, মঙ্গলবার দিনভর তিনিসহ লঞ্চ মালিক সমিতির লোকজন নারায়ণগঞ্জের সদর, বন্দর ও নৌ থানায় ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো থানাই এ ঘটনায় মামলা নিতে রাজি হয়নি। তিনি বলেন, ‘নৌ থানায় মামলা তো নিলই না উল্টো হুমকি দিল এক এসআই। বলল, আমারেই আটক করবে।’

এ বিষয়ে মঙ্গলবার রাতে সাংসদ শেখ তন্ময়ের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সাংসদের ব্যক্তিগত সহকারী শেখ শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি স্যারের (সাংসদের) রাজনৈতিক বিষয়গুলো দেখি। আপনারা স্যারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।’

ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং ঢাকা সদরঘাট কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৮ মার্চ এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজটিকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। তবে কার্গো জাহাজটিকে নৌপথের চলাচলের জন্য সার্ভে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কথা ছিল, সার্ভে অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজটি ডকইয়ার্ডেই থাকবে। কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় জাহাজটি।

ধাক্কা দেওয়া কার্গো জাহাজটির মালিকানার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্য জড়িত বলে আমরা জেনেছি। আমরা মনে করি এ কারনেই পুলিশ লঞ্চ মালিক পক্ষের মামলা নিচ্ছে না।
বদিউজ্জামান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি

সার্ভে অনুমোদন না দেওয়া প্রসঙ্গে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিংয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিধি অনুযায়ী দেড় হাজারের বেশি ব্রেক হর্স পাওয়ার (বিএসপি) ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনের নৌযান চালাতে ইনল্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু জাহাজটিতে চালক হিসেবে একজন প্রথম শ্রেণির মাস্টারের কাগজ দেওয়া হয়। যথাযথ চালক না থাকায় এর সার্ভে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং ঢাকা সদরঘাট কার্যালয়ের প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার মাহাবুব রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, এমভি এসকেএল-৩ নামের কার্গোটিকে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হলেও জাহাজটিকে সার্ভে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনুমোদন না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

উদ্ধার না করে পালিয়ে যায় জাহাজটি

গত রোববার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাথরঘাট কয়লাঘাট এলাকায় বেপরোয়া কার্গোর ধাক্কায় ডুবে যায় এমএল সাবিত আল হাসান নামের যাত্রীবাহী লঞ্চটি।

লঞ্চডুবির পর সাঁতরে তীরে উঠে আসা দীপু (১৮) নামের এক তরুণ প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চকে ধাক্কা দেওয়ার অনেক আগে থেকেই যাত্রীরা চিৎকার করে কার্গো জাহাজটির গতিরোধের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু জাহাজের চালক তাতে সাড়া দেননি। এমনকি পুরো ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার সময়ে বা আগে কোনো ধরনের হর্নও বাজাননি জাহাজের চালক। ঘটনার আরও তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী একই ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন।

ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী একটি লবণ মিলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, যাত্রীবাহী দোতলা লঞ্চটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় কার্গো জাহাজটি। ধাক্কার স্থান থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে গিয়ে নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের কাছে লঞ্চটি ডুবে যায়। পুরো ঘটনাটি ঘটতে প্রায় ২০ সেকেন্ড সময় লেগেছে। এ সময় ডুবন্ত লঞ্চে থাকা বেশ কিছু যাত্রী নদীতে সাঁতরাতে থাকেন। তবে যাত্রীদের উদ্ধার না করে দ্রুত চলে যেতে দেখা যায় কার্গো জাহাজটিকে।

নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা তৃতীয় সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের নিরাপত্তাকর্মী মো. হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কার্গো জাহাজটি দ্রুতগতিতে পেছন থেকে এসে লঞ্চটিকে ধাক্কা দিলে সেতুর ১৫ ও ১৬ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি অংশে লঞ্চটি ডুবে যায়। ঘটনার আগে আমরা মাইকিং করে জাহাজটিকে সতর্ক করলেও জাহাজচালক সেই কথা শোনেননি।’

দোষিদের বাঁচানোর জন্যই বিআইডব্লিইটিএ মামলা করেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থা নারায়ণগঞ্জ জোনের সভাপতি বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধাক্কা দেওয়া কার্গো জাহাজটির মালিকানার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্য জড়িত বলে আমরা জেনেছি। আমরা মনে করি একারনেই পুলিশ লঞ্চ মালিক পক্ষের মামলা নিচ্ছে না।’