মানিকগঞ্জের দর্শনীয় স্থান ‘ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি’

মানিকগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হরিরামপুর উপজেলার ‘ঝিটকা পোদ্দার বাড়ি’। এটি জেলার ঐতিহ্য
ছবি: আব্দুল মোমিন

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা। ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ। ইছামতী নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা ঝিটকা হাট ও বাজার এখন জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঝিটকায় দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা গড়েন দুই সহোদর। দ্রুতই ‘ঝিটকা পোদ্দারবাড়ি’ নামে পরিচিতি পায় এটি। বর্তমানে এটি জেলার দর্শনীয় স্থান।

স্থানীয় আনন্দ মোহন পোদ্দারের দুই সন্তান—যোগেশ্বর মোহন পোদ্দার ও রায়চরণ মোহন পোদ্দার। সে সময় ঝিটকা ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আকারে ধনে, পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ হতো। ঝিটকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদী দিয়ে এসব মসলাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। উনিশ শতকের শুরুর দিকে দুই ভাই যোগেশ্বর মোহন পোদ্দার ও রায়চরণ মোহন পোদ্দার ধনের ব্যবসা শুরু করেন। নৌকায় করে ধনে ভারতের কলকাতায় নিয়ে বিক্রি করতেন তাঁরা। সে সময় দুই ভাই বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। পরে স্থানীয় ঝিকুটিয়া মৌজায় ৭ একর জমি কেনেন। ইছামতীর পাশে ২ দশমিক ৭৫ একর জমির ওপর নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। এই বাড়ির পূর্ব পাশে যোগেশ্বর পোদ্দার এবং পশ্চিম পাশে রায়চরণ পোদ্দার ও তাঁদের সন্তানেরা বসবাস করতেন। বাড়িটিতে দক্ষিণ ও পূর্ব পাশে দুটি এবং উত্তর পাশে দুটি বিশাল পুকুর। এ ছাড়া পূর্ব পাশে আছে কৃষিজমি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যোগেশ্বরের বংশধরেরা ভারতে চলে যান। তবে রায়চরণের বংশধরেরা বাড়িতেই থেকে যান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করলেও ২ একর জমি বাড়ির বংশধরদের রয়ে যায়। বর্তমানে এই বাড়ির এক পাশে রায়চরণ পোদ্দারের নাতি রথীন্দ্রনাথ পোদ্দার মাঝে মাঝে এসে থাকেন। তিনি এলাকার অন্য একটি বাড়িতে থাকেন।

বাড়িটিতে ঢুকতেই সবুজ মাঠের দক্ষিণ পাশে পুকুরের দৃষ্টিনন্দন ঘাট। এর পাশে বিশাল চৌচালা ঘর। ঘরটির চাল টিনের হলেও চারপাশের দেয়াল কাঠের। চারপাশের বারান্দাও কাঠের তৈরি। এই ঘরেই বিচার–সালিস হতো। এর উত্তর পাশে পূর্ব-পশ্চিমে দৃষ্টিনন্দন বিশাল আধা পাকা ঘর। এর পেছনে অর্থাৎ উত্তর পাশে আছে দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্বমুখী কারুকার্যখচিত তিনটি প্রাসাদ। একতলাবিশিষ্ট প্রতিটি প্রাসাদে চার থেকে পাঁচটি করে বিশালকায় কক্ষ। এই প্রসাদেই থাকতেন পোদ্দার বাড়ির সদস্যরা। তবে সংস্কারের অভাবে প্রাসাদগুলো এখন জরাজীর্ণ। বাড়ির চারপাশে আম, নারকেল, কাঁঠালসহ বিভিন্ন গাছগাছালি।

ঝিটকা পোদ্দার বাড়ির ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা

বাড়িটির কাঠের ঘরটিতে এখন বাল্লা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের কার্যক্রম চলে। ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এই পোদ্দারবাড়ি আরও আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এই বাড়ির পাশের জমিতে লেক, সুইমিং পুল, শিশুপার্কসহ পিকনিক স্পট নির্মাণ করা হবে।

দেশীয় ঐতিহ্য ঘুড়ি উৎসব ও মেলা বসত এই বাড়িতে। ১৯৯৮ সাল থেকে রায়চরণ পোদ্দারের নাতিন-জামাই রঞ্জন সাহা এই উৎসবের আয়োজন করতেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকেই আসতেন উৎসবে। ২০১৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এখানে আর ঘুড়ি উৎসব ও মেলা হয়নি।

এই বাড়ি দেখতে প্রতিদিন জেলার বাইরে থেকেও দর্শনার্থীরা আসেন। রাজধানী থেকে পোদ্দারবাড়িতে পৌঁছাতে সড়কপথে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লাগে। হেমায়েতপুর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক হয়ে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা থেকে সরাসরি ঝিটকায় যাওয়া যায়। সেখান থেকে পাকা সড়ক হয়ে মাত্র এক কিলোমিটার এগোলেই চোখে পড়বে পোদ্দারবাড়ি।