মাঝরাতে ছোট্ট আফরিনের শেষবিদায়ে কাঁদল প্রতিবেশীরাও

আফরিনকে শেষবারের মতো দেখতে বাড়িতে ভিড় করে এলাকাবাসী। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহীর হাট রামচন্দ্রপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ির কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল মানুষের ভিড়। রাতের নীরবতা ভেঙে থেমে থেমে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ থেকে শুরু করে ছোটরা—সবাই শেষবারের মতো আফরিনকে একনজর দেখতে এসেছে। ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত ১২টা, তখন শোনা গেল অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।

আফরিনের দুই ফুফুকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে প্রায় অচেতন অবস্থায় নামানো হলো। বাবা আজিজুল হকের হুঁশ ছিল। নেমেই শব্দ করে কেঁদে ফেললেন। বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা আফরিনের মা ছুটে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট আফরিনের নিথর দেহ অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাড়ির উঠোনে নামানোর পর কেউ আর কান্না ধরে রাখতে পারল না। আপনজনদের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠল পরিবেশ।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টায় সাত বছরের শিশু আফরিনকে চিরবিদায় জানানো হয়। রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের হাট রামচন্দ্রপুর গ্রামে নিজ বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।

আফরিন হক

গত বুধবার সকালে বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে স্কুলে যাওয়ার পথে ট্রাকচাপায় আফরিন আহত হয়। তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে ট্রাকটি চলে যায়। পরে তৎক্ষণাৎ তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল শিশুটি। ওই দিন বিকেলে চিকিৎসকের পরামর্শে আফরিনকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) পাঠানো হয়। সেখানে আফরিনকে বাঁচাতে তার ডান পা কাটা হয়। এরপর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানেই বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে সে মারা যায়। তার পায়ের ওপরে পেট, মূত্রনালিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আফরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার বাবা আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা দপ্তরের অফিস সহায়ক। আফরিনরা দুই বোন। সে ছিল বড়।

রাজশাহী নগরের খড়খড়ি বাইপাস থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে তাদের বাড়ি। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে দেখা যায়, রাস্তার দুই অংশে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ওই দুই অংশে রাস্তা ভেঙে সরু হয়েছিল। স্থানীয় চেয়ারম্যান দুর্ঘটনার পরই তা মাটি দিয়ে ভরাট করেন। আফরিনের বাড়ির আগেই বাজার। নাম হাট রামচন্দ্রপুর। সেই বাজার থেকে তার বাড়ির দূরত্ব প্রায় ৩০০ মিটার হবে। গ্রামের বাজারেও এত রাতে অনেক মানুষ। সবাই তাকিয়ে আছে আফরিনকে একনজর দেখার জন্য। সেখানে বসে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম। তিনি বললেন, তিনি আফরিনকে মাঝেমধ্যে চকলেট কিনে দিতেন। ওর হাসিমুখটা এখনো ভেসে আছে।

সেখান থেকে একটু সামনে যেতেই ভিড় আরও বেড়ে যায়। কান্নার আওয়াজও আসতে থাকে। গ্রামের প্রায় সবাই যেন ওই ছোট্ট বাড়িতে এসেছে। বাড়িতেই ছিলেন আফরিনের মা মাসুরা বেগম। মেয়ের অপেক্ষায় কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। পাশের ঘরেই দাদা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা গেল। কথা বলতে পারছেন না তিনি।

সেখানে গিয়ে এ দুর্ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী মো. আলাল উদ্দিনকে পাওয়া গেল। রামচন্দ্রপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তিনি বলেন, তিনি যখন শহর থেকে কলেজে আসেন, তখন ঘটনাস্থলে দেখতে পান, একটি মোটরসাইকেলে করে স্কুলড্রেস পরানো একটি শিশুকে নিয়ে যাচ্ছে। ওই মুহূর্তে রাস্তায় একটি ট্রাক ঢুকে পড়ে। ওই জায়গাটি খুব চাপা এবং বাঁক রয়েছে। ট্রাককে সাইড দেওয়ার জন্য মোটরসাইকেল রাস্তার পাশে থামানো হয়। পরে ট্রাক ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা শিশুটি পড়ে যায়। পরে চলন্ত ট্রাক তার পায়ের ওপর দিয়ে যায়।

এই কলেজশিক্ষক আরও বলেন, এলাকায় পুকুর খননে ধুম পড়েছে। আর তার মাটি নেওয়া হয় এলাকার ইটভাটায়। তাঁরা বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে সব সময়ই চিন্তায় থাকেন, কখন কী হয়ে যায়।

এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, আফরিনকে এবারই স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সে মেধাবী ছিল। কিন্তু অকালেই ঝরে গেল। তিনি জানালেন, এ রাস্তায় মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। বেপরোয়া গতিতে ট্রাক-ট্রলিগুলো চলে। এদের বলেও কিছু হয় না।
এলাকাবাসী এটাকে দুর্ঘটনা বলতে চান না। এর সঙ্গে জড়িত ট্রাকচালক ও সহকারীকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি তাঁদের।

এলাকাবাসী ও পরিবারের নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ১২টা বেজে যায়। ওই সময় অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। অ্যাম্বুলেন্স ধরেই তাদের চিৎকার। পলিথিনে মোড়ানো দেহটা অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে বাড়ির উঠানে রাখা হয়। সবার একনজর দেখার জন্য সেখানে আফরিনের মুখটুকু খোলা হলো।

মেয়ের লাশের সামনে মায়ের আহাজারি

কোত্থেকে মামা মাসুদ রানা এসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ভাগনি আফরিনকে চুমু খেলেন। দাদা আবদুস সাত্তারও হাউমাউ করে কেঁদে ভিড় ঠেলে আফরিনকে দেখলেন। অল্প সময়েই হুঁশ হারিয়ে ফেললেন। মা কয়েক দফা এসে আফরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চুমু খেতে লাগলেন। তখনই মাইকে ঘোষণা এল, আফরিনের জানাজার নামাজ রাত দেড়টায়।

খানিক পর দাদা আবদুস সাত্তারের সঙ্গে কথা হয়। হু হু করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার কত সুখের সংসার। সব তছনছ হয়ে গেল। আমার কাছে আফরিন এসে বলবে না আর, “একটা চকলেট দাও না, দাদু।”’